নিত্যপণ্যের বাজার যেন অশ্বমেধের ঘোড়া। সঙ্গে আছে নির্বাচনপূর্ব সতর্কতা আর নাভিশ্বাস ওঠা মুদ্রাস্ফীতি। এত সব বিষয়ের মধ্যে বলতে গেলে এবার পূজার বাজারের পালে সেভাবে যেন বাতাস লাগেনি। পূজা শুরুর ঠিক আগে আগে বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কেমন যাচ্ছে পূজার বাজার। কেনাকাটা নিয়ে উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে মিলেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
যেকোনো উৎসবের আগে প্রতিবেশী দেশে গিয়ে বেড়ানোর অছিলায় কেনাকাটা করার ধারা নতুন নয়। এবার এই চলাচলে কিছুটা ভাটার টান রয়েছে ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায়। তাতেও যে কেনাকাটায় খুব এটা উন্নতি হয়েছে, সেটাও বলা যাবে না। অন্তত তেমন মনোভাব ব্যক্ত করেছেন সিংহভাগই। অনুঘটক হিসেবে আরও দুটি বিষয় উঠে এসেছে। এক, গেল ঈদের পর থেকে আশাবাদী হওয়ার মতো অবস্থা না থাকার ফলে স্টক জমে গেছে। সেগুলোর সঙ্গে কিছু নতুন পোশাক দিয়ে পূজাসংগ্রহ করা হয়েছে। দুই, দিনের পর দিন ছাড় দিয়ে ক্রেতা আকৃষ্ট করার চেষ্টায় রয়েছেন উদ্যোক্তারা। উভয় বিষয়ই নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা। অনেকে বলছেন, বিদেশে উৎসব উপলক্ষে ছাড় দেওয়া প্রচলিত রীতি। কিন্তু আমরা এই প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত নই। ফলে দিনের পর দিন ছাড় দেওয়া হলে ক্রেতাকে বেপথ করা হবে; তাতে করে নিজেরাই নিজেদের ফাঁদে পড়ে যাওয়ার শঙ্কা বাড়বে।
অন্যদিকে, পুরোনো স্টকের সঙ্গে নতুন সংগ্রহ মিলিয়ে পূজাসংগ্রহ বাজারজাত করার কথা কেউ কেউ স্বীকার করলেও বেশির ভাগই বিষয়টির সঙ্গে একমত হননি। বরং তাঁরা বরাবরের মতো নতুন সংগ্রহ পূজার জন্যই বাজারে এনেছেন বলে জানিয়েছেন। মনস্তাত্ত্বিকভাবে কেনাকাটা একধরনের বিনোদন। করোনাভাইরাস সংক্রমণে সারা বিশ্ব অচল থাকার পর সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করলে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে কেনাকাটায়। এই অবস্থাকে বিশেষজ্ঞরা অভিহিত করেছিলেন ‘রিভেঞ্জ শপিং বা প্রতিশোধের কেনাকাটা’ হিসেবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা হওয়ার সুযোগ অবশ্য নেই। কারণ, বল্গাহীন বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে। ফলে সাধারণ মানুষের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। এজন্য রিভেঞ্জ শপিং এখন দূরঅস্ত। বরং মানুষ চিন্তিত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া নিয়ে। যদিও ‘পূজায় চাই নতুন জামা’র বিষয়কে বিবেচনায় না রেখেও উপায় থাকে না। তাই শপিং করা হলেও পকেট-পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক থাকছেন সবাই।
বাজার পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট, এরই মধ্যে কেনাকাটা কিছুটা হলেও ঊর্ধ্বমুখী। অন্তত এ মাসের প্রথম ১০ দিনের চিত্রে সেটা প্রতীয়মান হয়েছে। মহালয়ার দিন থেকে দেবীপক্ষের সূচনা হয়েছে। তবে রাজনৈতিকভাবে মাঠ গরম থাকার কারণে সাধারণ মানুষের জন্য কেনাকাটা হয়ে গিয়েছিল অনিশ্চিত। পাশাপাশি ভিআইপি মুভমেন্টে নগরী যানজটে কাহিল ছিল। ফলে মানুষের পক্ষে কেনাকাটা করতে বেরোনো অনেকটাই অসম্ভব ছিল। কোনো কোনো ফ্যাশন ব্র্যান্ড অবশ্য বলেছে যে এরই মধ্যে তারা গেলবারের লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। আবার অনেকের প্রবৃদ্ধি থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না বলেও জানানো হয়েছে। এথনিক এবং ওয়েস্টার্ন উভয় ঘরানার ফ্যাশন ব্র্যান্ডের সঙ্গে কথা বলেই মিলেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আড়ংয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে তাদের ইতিবাচক পরিস্থিতির কথা। তাদের প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
তবে ঢাকার বাজার শেষের সপ্তাহটা জমেছে বলে জানা গেছে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে।
আবার কারও কারও মতে ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে কেনাকাটা ভালো হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে বর্তমানে উপজেলাগুলোতেও চলছে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড। ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তৃত হয়েছে দেশজুড়ে। সেখানেও মানুষের হাতে অর্থ আছে। ফলে ঢাকা বা এর আশপাশের অঞ্চলগুলো ছাড়া ঢাকায় এসে আগের মতো কেনাকাটা করতে চান না তারা। এর প্রভাব মফস্সলের কেনাকাটাকে প্রভাবিত করেছে। এই ধারা বিকেন্দ্রীকরণের চমৎকার উদাহরণ হতে পারে বৈকি। একটা বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, যেকোনো উৎসবে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর টার্নওভারে বিশেষ ভূমিকা রাখে বসুন্ধরা সিটি শপিং মল। বিশেষত, লেবেল ৭ জুড়েই তো ছিল সব ব্র্যান্ডের আউটলেট; কিন্তু কয়েক মাস আগে এই ফ্লোর থেকে তাদের উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে এখনো নতুন আউটলেট খুলতে পারেনি অন্য কোনো ফ্লোরে।
এদিকে দেশী দশের ব্র্যান্ডগুলো ছিল বসুন্ধরায়। তাদের এখন মাথায় হাত। লেভেল ৭ থেকে তাদের সরিয়ে দেওয়ার পর জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা তারা বুঝে পায়নি এখনো। ফলে কবে আবার তারা দোকান চালু করতে পারবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত না। কোনো সন্দেহ নেই, তাদের জন্য একটা বড় ধাক্কা। এদিকে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকার ফলে তাদের পক্ষে কোনো বিকল্প মার্কেটিং প্ল্যান করাও সম্ভব হচ্ছে না।
ছোট ব্র্যান্ডগুলো ভালো আয় করেছে। বিশেষ করে যাদের কোনো শাখা আছে কি নেই, তারা মূলত অনলাইন–নির্ভর। বেশ যত্ন নিয়ে পূজাসংগ্রহ সাজিয়েছে তারা। এর ফলও পাচ্ছে। তাদের পণ্যের দামও বেশ নাগালের মধ্যে। ফলে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষেই তাদের কাছ থেকে পণ্য কিনেছেন ক্রেতারা। অনেক ব্র্যান্ড তো ডেলিভারি দিতে গিয়েই হিমশিম খেয়েছে। তাদের ডিজাইনে আছে নানা থিম। আছে নতুনত্ব আর বৈচিত্র্য। এসবই ক্রেতা আকর্ষণের কারণ, তাতে সন্দেহ নেই। তবে কেবল স্থানীয় ব্র্যান্ডই নয়, বরং নন-ব্র্যান্ডেরও অবস্থা উল্লেখ করার মতো নয়। বরং নিউমার্কেট, গাউছিয়ার মতো বাজারে গিয়েও আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয় সেই অর্থে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরিস্থিতি যেমনই হোক, কেনাকাটা করতেই হবে, করেছেনও সাধারণ মানুষ। হয়তো ব্যয়ে কিছুটা লাগাম টানতে হয়েছে অবস্থাদৃষ্টে। তবুও আশা করছি যে শারদ উৎসব সবার জন্য হয়েছে আনন্দময় ও উপভোগ্য।
কৃতজ্ঞতা সূত্র: আড়ং; খালিদ মাহমুদ খান, পরিচালক, কে ক্র্যাফট; শাহীন আহম্মেদ, শীর্ষ নির্বাহী, অঞ্জন’স; সৌমিক দাস, প্রধান নির্বাহী, রঙ বাংলাদেশ; জেসন দাস, হেড অব অপারেশনস, ক্লাবহাউস; আফরিনা হাবিব, অ্যাসিস্ট্যান্টর জেনারেল ম্যানেজার (মার্কেটিং), লা রিভ।