একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা মিতু (ছদ্মনাম)। প্রতি সপ্তাহেই ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ থেকে পণ্য কেনেন তিনি। ফেসবুক পেজ থেকে পণ্য কেনার সবচেয়ে বড় ঝামেলা দাম। ‘প্রাইস প্লিজ’ লিখলেই ফিরতি কমেন্টে অনুরোধ আসত ‘ইনবক্সে আসুন’। আগে খুব আগ্রহ নিয়ে ইনবক্সে যেতেন। কিন্তু এখন আর তেমন আগ্রহ পান না। যেসব পেজে পণ্যের দাম ও ফিচার একসঙ্গে থাকে, সেখান থেকেই পণ্য কেনেন।
অনলাইনে যাঁরা কেনাকাটা করেন, তাঁদের সবারই কমবেশি এই অভিজ্ঞতা। অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠানও দাম জানতে ইনবক্সে যেতে বলেন। কেন প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে সরাসরি দাম বলতে চান না?
গ্রাহকের মনোযোগ টানতে
ফেসবুকে নানা রকম গ্রাফিকস করে পোস্ট দিয়ে গ্রাহকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বিক্রেতারা। পণ্যের ছবি ও ফিচার লিখিত আকারে দিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান বুস্ট করে। অনলাইনে গয়নার দোকান সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি। প্রতিষ্ঠানটির গয়না ডিজাইনার ও স্বত্বাধিকারী জেরিন তাসনিম খান বলেন, ‘আমি এফ-কমার্স ও ই-কমার্স মানে ফেসবুক ও ওয়েবসাইট—দুই মাধ্যমেই পণ্য বিক্রি করি। আমাদের গ্রাহকের অধিকাংশই কর্মজীবী শিক্ষিত নারী। নানান উপকরণের গয়না তৈরি করে বিক্রি করি আমরা। বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য আমরা ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করি। আমরা সব পণ্যের তথ্য ফেসবুক ও ওয়েবসাইটে বিস্তারিত প্রকাশ করি। এখন বিভিন্ন পেজের তথ্য বা ছবি প্রকাশের পর ফলোয়ার বা যাঁরা লাইক করেছেন, তাঁদের কাছে যাওয়ার মাত্রা কমে গেছে, মানে ফেসবুকের রিচ কমে গেছে। যে কারণে আমাদের কিছুটা কৌশলী হতে হচ্ছে। আমরা চাই আমাদের পণ্যের তথ্য অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যাক। যে কারণে আমরা পণ্যের তথ্য ও ছবি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকদের ফেসবুক মেসেঞ্জার তথা পেজের ইনবক্স অর্ডার করতে অনুরোধ করি।’
গ্রাহকের প্রশ্ন-জিজ্ঞাসায় সহায়তা করে ইনবক্স
একেক গ্রাহকের একেক রুচি, একেক ধরনের পণ্য নিয়ে জিজ্ঞাসা। উদ্যোক্তা জেরিন তাসনিম খান জানান, যাঁরা যোগাযোগ করেন, তাঁদের আমরা গয়নার বিস্তারিত তথ্য ও ডেলিভারির উপায় সম্পর্কে জানাই। একেকজন গ্রাহক একেক জায়গায় থাকেন। একেকজন গ্রাহক নিজের রুচি ও ধরন অনুযায়ী পণ্য অর্ডার করেন। এসব সরাসরি ফেসবুক পোস্টের নিচে আলোচনা করা যায় না। যে কারণে ইনবক্সে গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করি আমরা। আমাদের ওয়েবসাইটে পণ্যের সব তথ্যাদি উন্মুক্ত থাকে। সেখানে গ্রাহক ছবি আর দাম দেখে সরাসরি পেমেন্টের মাধ্যমে পণ্য কিনতে পারেন।
পেজের প্রচার-প্রসার বাড়াতে ইনবক্স
এখন ফেসবুকে বিভিন্ন পেজের লাইক অনুপাতে পোস্টের রিচ বেশ কমে গেছে। এফ-কমার্স উদ্যোক্তারা নানাভাবে পণ্য ও সেবার কথা বেশি বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চান। যে কারণে তারা চান বিভিন্ন পোস্টে গ্রাহকেরা যেন কমেন্টস করেন। অনলাইন ফ্যাশন উদ্যোগ দিশা’স রোড ব্লক পেজের কর্ণধার সায়কা শাহরিন নানা ধরনের ফ্যাশন পণ্য তৈরি করেন। বিভিন্ন রকম ব্লক, হাতে আঁকা নকশা ও ডিজিটাল প্রিন্ট নিয়ে কাজ করছেন। সায়কা বলেন, ‘ফেসবুক কমার্সের দুনিয়ার ব্যাপ্তি অনেক। এখনকার এফ-কমার্স ক্রেতাদের সত্যিকার অর্থে মনোযোগ কম। মানে এত বিজ্ঞাপন, এত পোস্ট, এত ছবির মধ্যে তাঁদের মনোযোগ ধরে রাখা বেশ কঠিন। আবার ফেসবুক অ্যালগরিদমের কারণে পেজের রিচ কমে গেছে। তাই যে গ্রাহক কমেন্ট করেন, তাঁর নেটওয়ার্কে থাকা ফেসবুক বন্ধুদের সামনে আমাদের পেজের উপস্থিতি পৌঁছানোর সুযোগ বাড়ে। যদিও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে পেজের উপস্থিতি বাড়ানো যায়, তাতে খরচ বাড়ে। আমরা চাই গ্রাহকের বেশি বেশি ইন্টার্যাকশন।’
প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার কৌশল
এফ-কমার্সের বাজার বেশ প্রতিযোগিতামূলক বলে উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করেন। উদ্যোক্তা সায়কা শাহরিন বলেন, ‘ফেসবুকে আমরা সাধারণত পণ্যের দাম প্রকাশ করি না। কারণ বাজারটা প্রতিযোগিতার। নিজের উদ্ভাবন করা কোনো পণ্য যখন নকল করে, কেউ তার চেয়ে কম দামে বিক্রি শুরু করে তখন মূল বিক্রেতা বিপদে পড়েন। যেহেতু ক্রেতা শুধু ছবি দেখে পণ্য কিনছেন, তাই কোয়ালিটি বোঝা কঠিন। ফলে ক্রেতারা কম দামের পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার হন। যেমন আমার প্রতিষ্ঠানের কোনো শাড়ির দাম হয়তো ১ হাজার ৫০০ টাকা। আমি স্বাভাবিকভাবে ছবিসহ দাম প্রকাশ করলে অনেকেই সেখানে কমেন্ট করেন। তখন অন্য একজন উদ্যোক্তা সেই একই ধরনের শাড়ি ১ হাজার ৪০০ টাকা দাম বলে গ্রাহকের ইনবক্সে যোগাযোগ করেন। অন্যদের এমন আচরণের কারণে আমাদের আর্থিক ক্ষতির সুযোগ থাকে। এ কারণে আমরা বিশেষ বিশেষ পণ্যের দাম প্রকাশ করি না।’ সব পেজের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি এমন, সেটা বলা যাবে না। বিভিন্ন স্টেশনারি, বই, ফার্নিচারসহ লাইফস্টাইল পণ্যের পেজে দামসহ তথ্যাদি প্রকাশ করা হয়। যাঁদের ব্যবসা বড় আর পণ্যের বহুমাত্রিকতা আছে, তাঁরা সরাসরি দাম প্রকাশ করেন বলে ইনবক্সে গ্রাহকেরা কম যোগাযোগ করেন। কিন্তু সৃজনশীল ফ্যাশন পণ্যের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের সঙ্গে ইনবক্সে যোগাযোগই ভরসা।
ক্রেতাকে বিশেষভাবে চেনার জন্য
ফেসবুক পেজের ক্ষেত্রে অনেক ক্রেতা একবার কেনাকাটা করে ভালো লাগলে বারবার সেখানে আসেন। অনলাইন বিক্রেতারাও চান তাঁদের গ্রাহকেরা যেন নিয়মিত তাঁদের পণ্য কেনেন। সে ক্ষেত্রে গ্রাহকের সঙ্গে পরিচিতি বাড়ানোর জন্য, ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরিতে ইনবক্সে আলাপের সুযোগ আছে। ঐতিহ্যবাহী কলমকারি নিয়ে কাজ করেন উদ্যোক্তা রিফাত লোপা। তাঁর উদ্যোগের নাম সুতলি। তিনি বলেন, ‘এফ-কমার্সে দুই ধরনের উদ্যোক্তা দেখা যায়। যাঁরা নিয়মিত ব্যবসা করেন আর আমাদের মতো একক উদ্যোক্তা, যাঁরা একক ভাবনা ও সৃজনশীলতা নিয়ে কাজ করছি। আমাদের মতো একক উদ্যোক্তাদের বড় একটি শক্তি হচ্ছে নির্দিষ্ট ক্রেতা। আমাদের পেজে হয়তো ১ লাখ অনুসারী বা লাইক আছে, কিন্তু দেখা যায় আমাদের পুরোনো ক্রেতার সংখ্যাই বেশি। পুরোনো ক্রেতাদের ধরে রাখতে, তাঁদের মনোযোগ টানতে আমরা ইনবক্সের সহায়তা নিই। ক্রেতার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে, ক্রেতার পছন্দ জানতে, বুঝতে আমরা ফেসবুক ইনবক্স ব্যবহার করি।’
উদ্যোক্তা রিফাত লোপা জানালেন, নিজের পেজে তিনি সব পণ্যের দাম প্রকাশ করেন। এখনকার গ্রাহকের হাতে মুঠোফোন থাকে। তাঁদের সঙ্গে আগের মতো দাম নিয়ে বেশি ছলচাতুরীর সুযোগ নেই। পেজ ভেদে ১০ টাকা থেকে ১০০ টাকা হয়তো দামের ভিন্নতা দেখা যায়। গ্রাহক ঠিকই তার দাম অনুসারে সঠিক পণ্য খুঁজে নেন। আর ফেসবুকে তো অনেক রিসেলার আছেন। তাঁরা পণ্যের দাম একেক গ্রাহকের কাছ থেকে একেক রকম রাখেন বলে দাম প্রকাশ না করে ইনবক্সে যোগাযোগ করতে বলেন।
কথা থাকে
শুধু প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ইনবক্সে ডাকাডাকি চলে, বিষয়টি এমন নয়। উদ্যোক্তা রিফাত লোপা বলেন, ‘ক্রেতার বিশেষ চাহিদা, ক্রেতার ঠিকানা, ক্রেতার বিশেষ কোনো আবদার থাকলে তা জানতে ইনবক্সে যোগাযোগ করা হয়। আবার উদ্যোক্তাদের জন্য ফেসবুক ইনবক্স বিশেষ কিছু সুবিধাও প্রদান করে। পণ্য বিক্রির অবস্থা, গ্রাহকের সর্বশেষ আপডেট জানতে ফেসবুক ইনবক্সের বিভিন্ন ফিচার ব্যবহারের সুযোগ আছে। ইনবক্সে যোগাযোগ করলে পেজের অ্যাডমিনরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যেখানে শুধু ছবি-পোস্টে কমেন্ট করলে ক্রেতার জিজ্ঞাসা মিস হয়ে যেতে পারে। ফেসবুক ইনবক্সে ক্রেতা যোগাযোগ করলে অর্ডারের প্রক্রিয়া, পণ্যের নানা তথ্যাদি পেশাদারভাবে শেয়ারের সুযোগ থাকে।