‘লাভ ছাড়াই ছেড়ে দিচ্ছি’

নিউমার্কেটে দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে একটা কথাই শুনবেন যে ‘লাভ ছাড়াই ছেড়ে দিচ্ছি।’
ছবি : সাবিনা ইয়াসমিন

সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শহরে মানুষজনের আনাগোনা কম দেখে হয়তো ভাবছেন নিউমার্কেটেও ভিড় কম হবে। শান্তিমতো দরকারি কিছু জিনিস কিনবেন বলে নিউমার্কেট এলাকায় পা দিয়েই দেখলেন সবাই আপনার মতোই ভেবেছে। কেনাকাটা দূরে থাক, শান্তিমতো হাঁটার রাস্তাটুকুও নেই, এত ভিড়। তবে একবার যখন এসেই পড়েছেন, তখন এই ঠেলাধাক্কা খেয়ে হলেও কেনাকাটাগুলো সেরে ফেলতে চাইবেন। ভিড়ভাট্টা ছাপিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে একটা কথা শুনে হয়তো অবাক হবেন, ‘লাভ ছাড়াই ছেড়ে দিচ্ছি।’ ফুটপাত থেকে বড় দোকান—প্রায় সব ব্যবসায়ীর মুখেই এই এক কথা। এত কেনাকাটা চলছে, তারপরও এই কথা? কয়েকজন ক্রেতা বলে উঠলেন, ছোটবেলা থেকেই তো এমনটা শুনে আসছি। কোনো কিছু কেনার পরই দোকানদাররা বলেন যে একবারে লাভ ছাড়া ছাইড়া দিছি।

এখানে কেনাকাটা করতে হলে দরদামে আপনাকে কৌশলী হতে হবে

২৫ অক্টোবর, বিকেল। মার্কেটের ১ নম্বর গেটের বাইরে ফুটপাতে বিছিয়ে সুর করে টি–শার্ট হাঁকাচ্ছেন ব্যবসায়ী সাইদুল (ছদ্মনাম), ‘এই লন এক শ, বাইছা লন এক শ...।’ কিছুক্ষণের মধ্যে সম্ভাব্য কিছু ক্রেতাও জুটে যায়। নারীদের মধ্যে মনে হয় যে দোকানে ভিড় বেশি, সেই দোকানে উঁকি মারার প্রবণতা আছে। তাই তো দেখতে দেখতে সাইদুলের দোকানে ভিড় বেড়ে যায়। এবার সাইদুল হাঁকাচ্ছেন, ‘একদাম দেড় শ, বাইছা লন দেড় শ...।’ ১৫-২০ মিনিটের ব্যবধানে একই জিনিসের দাম হঠাৎ ৫০ টাকা বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সাইদুল বললেন, ‘লাভ করতে হইব না?’ ‘তাহলে আগে এক শ চাইলেন কেন?’ সাইদুল চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘কই এক শ চাইলাম?’ বুঝলাম তর্কে গিয়ে লাভ নেই। এটাই এখানকার বেচাকেনার রীতি।

সব সময় নিউমার্কেটে থাকে ক্রেতাদের আনাগোনা

মার্কেটের ভেতরে শাড়ি-কাপড়ের দোকান ঘুরে বুঝলাম, এখানে কেনাকাটায় ঘোর মন্দা না থাকলেও দোকানদারের মুখ বেজার। দুর্গাপূজায় যতটা লাভের মুখ দেখবেন আশা করেছিলেন, শাড়ি ব্যবসায়ীরা ততটাই নাকি আশাহত হয়েছেন।

খান ব্রাদার্স শাড়ির সামির উদ্দিন খান বলছিলেন, ‘ঈদ, পূজা-পার্বণের চেয়ে বিয়েশাদিতে আজকাল বেশি শাড়ি কেনে মানুষ।’ থ্রিপিস এবং গজ কাপড়ের দোকানিরাও বলছিলেন, একদমই লাভ নেই। ম্যাচিং ফেয়ার কাপড়ের দোকানের কর্ণধার হাজি মোহাম্মদ গম্ভীর মুখে দিলেন লাভ-লোকসানের হিসাব। বললেন, ‘দিনে দোকানের খরচ ৯ হাজার টাকা আর বেচা হয়েছে ৫ হাজার টাকা, লস না, বলেন?’ কিন্তু উৎসব শেষেও ক্রেতাদের ব্যাপক আনাগোনায় মুখর নিউমার্কেট দেখে কিন্তু তেমনটা মনে হলো না।

এখানকার দোকানিদের অভিযোগ, মানুষ এখন কাপড় না কিনে নাকি স্বর্ণ কেনে। সত্যতা যাচাই করতে স্বর্ণের দোকানগুলোয় একটু ঢুঁ মারলাম।

যমুনা, ইয়েলো, আবির, রাজ, পিউর গোল্ড এবং সবশেষে আমিন জুয়েলার্সের দোকান ঘুরে বুঝলাম, বিষয়টা আসলে ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’ এমন ধরনের ঘটনা। আমিন জুয়েলার্সের নিউমার্কেট ব্রাঞ্চ ম্যানেজার কাজি ওমর জানালেন, ‘স্বর্ণের ভরি ১ লাখ টাকা পেরোনোর পর ক্রেতাদের আগ্রহ কমেছে। তাই স্বর্ণ ব্যবসা যে খুব ক্রেতা পাচ্ছে, এমনটা আর নেই।’

হীরার দোকানেও ক্রেতার আনাগোনা নেই। ডি ডায়মন্ডসের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মোহাম্মদ স্বপন বলেন, ‘হীরা তো আসলে শখের জিনিস, সে রকম শৌখিন লোক কম। তাই হীরার বাজার খুব একটা ভালো যাচ্ছে না।’

সোনা আর হীরার ব্যবসা যেমন চলুক, কম দামে বাহারি ইমিটেশন গয়নার দোকানগুলো দেখলাম বেশ ভালোই ক্রেতা পাচ্ছে। তবে লাভ-লোকসানের কথা জিজ্ঞেস করতেই তাঁরাও দাবি করলেন, ‘নাহ, তেমন কোনো লাভ নেই।’

ক্রেতাদের এত আনাগোনা আর বেচাকেনা চলছে, তারপরও কেন এখানকার বিক্রেতারা এত অখুশি, এই কথা ভাবতে ভাবতে ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, শুনতে পাই দোকানি আর ক্রেতার কথোপকথন। ‘আর বইলেন না আপনারে কেনা দামের কমে দিয়া দিলাম। আমার কোনো লাভই হইল না।’ বুঝতে পারলাম ক্রেতার কাছে ৫ হাজার টাকা দাম হাঁকানো শাড়িটি তিনি বিক্রি করলেন ১ হাজার ২০০ টাকায় আর এটাই হলো তার লাভ না থাকার কারণ।