এক দশক আগেও দেশের কফির বাজারে বড় শিল্পগোষ্ঠীর আধিপত্য তেমন ছিল না। সুইজারল্যান্ডের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান নেসলেই মেটাত কফির সিংহভাগ চাহিদা। এর বাইরে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান কফি আমদানি করে বাজারজাত করত। তবে মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে নেসলের পর কয়েকটি শিল্প গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠান এই বাজারে যুক্ত হয়েছে। গত অর্থবছরে তারা শীর্ষ তালিকায় উঠে এসেছে।
কফি বাজারজাতকরণে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বাংলাদেশে এখনো ১৫ শতাংশ বাসায় কফি পান করা হয়। সেখানে চা পান করা হয় ৯০ শতাংশের বেশি বাসায়। কফি–সংস্কৃতি চালু হওয়ার পর কফি পানের হার বাড়ছে। তরুণ প্রজন্ম কফি পানের দিকে ঝুঁকছে। এই প্রবণতা এই বাজারে সম্ভাবনা হিসেবে দেখছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো।
কফির বাজারে সম্ভাবনার কারণে দেশেও কফির আবাদ বাড়ছে। এতে আমদানিনির্ভরতা কমবে। আবার কফি চাষকে কেন্দ্র করে নতুন উদ্যোক্তাশ্রেণিও গড়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে কফি বাজারজাত শুরু হয় নেসলের হাত ধরে। ১৯৯৮ সালে নেসলে প্রথম কফি বাজারজাত করে এ দেশে। এরপর আরও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কফি এনে বাজারজাত শুরু করে বাংলাদেশে। নেসলে আনুষ্ঠানিকভাবে কফি বাজারজাত শুরুর এক দশকে খুব বেশি বাড়েনি এই বাজার।
চলতি শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে মূলত তরুণদের খাদ্যাভ্যাসে যুক্ত হতে থাকে কফি। ইনস্ট্যান্ট কফি দিয়ে শুরু হলেও নানা স্বাদের কফি নতুন মাত্রা যোগ করে। কফি পানের জন্য নতুন নতুন ক্যাফেতে বিনিয়োগ করেন শিল্প উদ্যোক্তারা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ইনস্ট্যান্ট কফি ও কফি বিন মিলিয়ে দেশে আমদানি হয়েছে ১৪ লাখ ৩৯ হাজার কেজি কফি। এর মধ্যে পৌনে সাত লাখ কেজি আমদানি করে নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড। মোট আমদানির ৪৭ শতাংশই নেসলের দখলে।
কফি আমদানিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আবুল খায়ের গ্রুপ। গত অর্থবছরে গ্রুপটি ১ লাখ ৫৯ হাজার কেজি কফি আমদানি করেছে। গ্রুপটির হাতে রয়েছে বাজারের ১১ শতাংশ। আবুল খায়ের গ্রুপ ‘আমা’ ব্র্যান্ডে ইনস্ট্যান্ট কফি বাজারজাত করছে। চার বছর আগে গ্রুপটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান আবুল খায়ের কনজ্যুমার প্রোডাক্টস লিমিটেড কফি বাজারজাত শুরু করে। শুরু থেকেই দ্রুত প্রবৃদ্ধি বাড়ছে তাদের। যেমন দুই বছর আগে কফি বাজারজাত বা আমদানিতে গ্রুপটি ছিল সপ্তম অবস্থানে। গত অর্থবছরে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে গ্রুপটি।
কফি আমদানিতে তৃতীয় স্থানে রয়েছে প্রাণ–আরএফএল। খাদ্যপণ্য বিপণন ও উৎপাদনকারী প্রাণ গ্রুপ ২০১৭ সাল থেকে মূলত বড় আকারে কফি বাজারজাত করতে থাকে। গত অর্থবছরে গ্রুপটি ১ লাখ ৩৫ হাজার কেজি কফি আমদানি করেছে। মোট কফি বাজারজাতের ৯ শতাংশ করেছে প্রাণ–আরএফএল গ্রুপ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে কফি আমদানি কমেছে। ২০২২–২৩ অর্থবছরে কফি আমদানি হয় ১৭ লাখ ৩২ হাজার কেজি। গত অর্থবছরে (২০২৩–২৪) তা কমে দাঁড়ায় ১৪ লাখ ৩৯ হাজার কেজিতে। এই হিসাবে কফি আমদানি কমেছে ১৭ শতাংশ। তবে আমদানি হ্রাসের এই ধারা সাময়িক বলে দাবি করেছেন কফি বাজারজাতকারীরা।
কফি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে কফি বিনের দাম ৩০ শতাংশ বেড়েছে। আবার দেশেও শুল্কহার বেড়েছে। দাম বাড়ার কারণে কফি পানের হার কিছুটা কমেছে। এ কারণে আমদানি কম। তবে এটা সাময়িক। কারণ, তরুণদের মধ্যে কফি পানের ঝোঁক রয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়লে কফি পানের হারও বাড়বে।
কফির বাজারে সম্ভাবনার কারণে দেশেও কফি চাষ দ্রুত বাড়ছে। তিন পার্বত্য জেলার পাশাপাশি টাঙ্গাইল, রংপুর, নীলফামারীসহ নানা এলাকায় এখন বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০–২১ অর্থবছরে ১২২ হেক্টর জমিতে কফি চাষ হতো। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৮০০ হেক্টর। ২০২২–২৩ অর্থবছরে যেখানে কফি বিন উৎপাদিত হয়েছিল ৬২ টন, সেখানে গত অর্থবছরে কফি বিনের উৎপাদন হয়েছে ৬৭ টন। তবে নতুন গাছ রোপণের পাঁচ–ছয় বছর পর ফলন দেয়। তাতে তিন থেকে চার বছর পর দেশে কফি বিনের উৎপাদন ৫০০ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আশা করছে।
জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কফি চাষ যেভাবে বাড়ছে, তাতে এক দশক পর দেশে কফি উৎপাদন দুই হাজার টন ছাড়িয়ে যাবে। কফির বাজারের সম্ভাবনা দেখে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান আমদানির পাশাপাশি চাষেও যুক্ত হয়েছে।