সুস্থ-সবল থাকার রহস্য বললেন শতবর্ষী হামিদা খাতুন

গত নভেম্বরেই ১০১তম জন্মদিন উদ্‌যাপন করলেন হামিদা খাতুন। বয়সের সেঞ্চুরি করেও দিব্যি সুস্থ-সবল আছেন তিনি। মানিকগঞ্জের জাবরা গ্রামে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছেন আব্দুল মোমিন

বয়সের সেঞ্চুরি করেও দিব্যি সুস্থ-সবল আছেন হামিদা খাতুন
ছবি: সুমন ইউসুফ

 হামিদা খাতুনের বয়স তখন পাঁচ কি ছয় বছর হবে; হঠাৎ প্রচণ্ড পেটব্যথা। তখন তো আর এখনকার মতো আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা ছিল না। চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, শিশুটির পেটে ঘা হয়েছে, সে আর বেশি দিন বাঁচবে না। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন মা-বাবা। চিকিৎসকের পরামর্শমতো সন্তানকে ওষুধ খাওয়াতে থাকলেন তাঁরা। সঙ্গে লবণ ছাড়া খাবার। দিন গেল, মাস গেল। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন হামিদা খাতুন। তাঁর বয়স এখন ১০১ বছর। এখনো দিব্যি হেঁটে–চলে বেড়ান, খাওয়াদাওয়াও স্বাভাবিক। খালি বয়সের ভারে হাঁটতে হয় লাঠিতে ভর করে। বয়সের সেঞ্চুরি করা মানুষটা মনের দিক থেকে এখনো উচ্ছল-প্রাণবন্ত।

গত ৬ নভেম্বর হামিদা খাতুনের শতবর্ষ উদ্‌যাপন করে তাঁর পরিবার-পরিজন। সে খবর জেনেই গিয়েছিলাম মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জাবরা গ্রামে। জাবরা বাজারের পাশেই হামিদার বাড়ি। হেমন্তের বিকেলে বাড়িতে ঢুকেই দেখি, লাঠিতে ভর দিয়ে টুকটুক করে উঠানময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন হামিদা খাতুন। পরে বারান্দায় বসে কথা হলো। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসলেন তিনি।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হামিদা খাতুন

মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামে ছিল হামিদাদের বাড়ি। তাঁর বাবা মাজেম আলী খানের কলকাতায় প্রেসের ব্যবসা ছিল। স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতাতেই থাকতেন তিনি। সেখানেই ১৯২২ সালের ৬ নভেম্বর হামিদার জন্ম। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় হামিদা। কলকাতাতেই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। প্রতিদিন প্রায় আট কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেতেন, আসতেন।

১৭ বছর বয়সে হরিরামপুরের ইব্রাহিমপুরের আকতার উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে হামিদা খাতুনের বিয়ে হয়ে যায়। তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের চিকিৎসক। তাঁদের পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে। ১৯৬৫ সালে পদ্মার ভাঙনে স্বামীর বাড়ি নদীগর্ভে চলে যাওয়ায় জাবরা গ্রামে আবাস গড়েন তাঁরা। ১২ বিঘা জমি বিক্রি করে চারচালা টিনের ঘর নির্মাণ করে সেখানেই থাকতে শুরু করে আকতার উদ্দিনের পরিবার।

হামিদা খাতুন

মুক্তিযুদ্ধের আগে আকতার উদ্দিনকে মিশনে সৌদি আরবে পাঠায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। একাত্তরে ছুটি নিয়ে দেশে আসেন তিনি। এরপর আর চাকরিতে যোগ দেননি। জাবরা গ্রামেই ১৯৭৩ সালে মারা যান তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর হামিদা খাতুন ধৈর্য ও সাহসে ভর করে সন্তানদের লালন-পালন করেছেন, গড়ে তুলেছেন শিক্ষিত করে। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাঁরা আজ স্বাবলম্বী।

পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লে কী হবে, পড়ালেখার প্রতি তাঁর প্রবল টান। এখনো বিভিন্ন ধরনের বই পড়েন। লেখাপড়ার গুরুত্ব বোঝেন। এলাকার মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন।

বই পড়ার পাশাপাশি তরুণ বয়স থেকেই পুঁতির দানা দিয়ে কারুকার্য, পুঁতি দিয়ে কাপড়ের ওপর কবিতা লিখতেন। যে ঘরে এখন থাকেন, সেখানে পুঁতি দিয়ে বড় বড় অক্ষরে কাপড়ের ওপর কবিতার কথামালা লেখা কিছু কারুকার্যও দেখা গেল।

এত বছর বয়সেও এমন সুস্থ-সবল থাকার রহস্য কী? বললেন, ‘ছোটবেলায় দেখেছি, সার বা কীটনাশক বলতে তেমন কিছু ছিল না। গোবর শুঁকিয়ে গুঁড়া করে জমিতে ছিটিয়ে দিত। আর রান্নার চুলার পোড়া ছাই ফসলে ছিটিয়ে দিত। এটি পোকামাকড় দমনে যথেষ্ট কার্যকর ছিল। কিন্তু কৃষকেরা এখন সার ও কীটনাশকে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর এই বিষযুক্ত খাবার প্রতিনিয়তই খাচ্ছে মানুষ। এতে নানা রোগব্যাধিতে ভুগতে হচ্ছে।’

আরেকটি কারণের কথাও বলেন, ‘ছোটবেলায় দেখেছি, গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গরু পালত। দুধ দিয়ে ভাত না খেলে খাওয়াই হতো না। আমাদের বাড়িতেও পাঁচ থেকে ছয়টি গরু ছিল। আমরা ভাইবোনেরা প্রতিদিন দুধ খেতাম। আর এখনকার ছেলেমেয়েরা দুধের প্রতি কেমন যেন বিরক্তি। ফাস্ট ফুড আর বিদেশি খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে তারা।’

নিজের সুস্থতার বিষয়ে বলতে গিয়ে জানান, সুস্থ থাকার জন্য সুষম খাবারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়েছে। বলেন, ‘খাবার খেলেই হবে না, পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।’

ছেলেরা বাড়িতে পাকা ভবন করলেও নিজের হাতে গড়া চৌচালা টিনের ঘরেই থাকেন হামিদা। বলেন, ‘তিনি (স্বামী আকতার উদ্দিন) নেই, তবে এই ঘরের সঙ্গে তাঁর সহস্র স্মৃতি জড়িয়ে আছে।’ তাঁর মতে, পরিবারের সঙ্গে থাকাতেই প্রকৃত আনন্দ। আর সুস্থ থাকাই জীবনে চরম সুখ।