কতটুকু দেরিকে দেরি বলা যায়?

অনেকেরই দেরি করার অভ্যাস আছে
ছবি: পেকজেলস

কবিতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘আমার খানিকটা দেরি হয়ে যায়।’

অনেকেরই আছে এই অভ্যাস। সবকিছুতে তাঁরা দেরি করেন। অফিসের মিটিং, বন্ধুদের আড্ডা কিংবা প্রিয়জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ—দেরি তাঁদের হবেই। তাঁরা ক্লাস মিস করেন, কোথাও যেতে বাস মিস করেন। এতে তাঁদের ব্যক্তিগত ক্ষতি তো হয়ই, ক্ষতি হয় অন্যদেরও। কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘নালিশ’ শিরোনামের একটি কবিতা আছে। কবিতার শেষ পঙ্‌ক্তিতে তিনি লিখেছেন, ‘দেরি করে যে এসেছে, ইচ্ছা করে ভালোবাসি তাকে।’

এসব গল্প-কবিতায় হয়। বাস্তবে হয় না। দেরি করে যে আসেন, আমরা তাঁদের প্রতি বিরক্ত হই। ভালোবাসা তো দূর।

কতটুকু দেরি গ্রহণযোগ্য?

মোক্ষম প্রশ্ন। দেরি করার গ্রহণযোগ্য সময় আসলে কতটুকু? এর জবাব দিয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিল বার্টন। একাধারে তিনি দার্শনিক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও লেখক। ‘দ্য সাইকোলজি অব লেটনেস’ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, পাঁচ মিনিটের দেরিতে কেউ হয়তো আপনার প্রতি বিরক্ত বা রাগান্বিত হবেন না। পাঁচ মিনিটের দেরি আসলে কোনো দেরিই না। দেরি হয় তখনই, যখন থেকে মানুষ বিরক্ত হতে শুরু করেন।

এই সময়সীমা স্থান বা ব্যক্তিভেদে কম-বেশি হতে পারে। তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন, মিটিং কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় পাঁচ মিনিটের বেশি সময়ের দেরিকেও হয়তো স্বাভাবিকভাবেই দেখা হয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে দু-এক মিনিটের দেরিও রীতিমতো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণত পাঁচ থেকে সাত মিনিটের দেরিকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একে বলা হয় ‘গ্রেস পিরিয়ড’ বা ছাড় সময়।

দেরির কারণে দলগত কাজে বিঘ্ন ঘটে

অন্যরা বিরক্ত হয় কেন?

আপনার দেরির কারণে দলগত কাজে বিঘ্ন ঘটে। কর্মস্থলের সামগ্রিক নিয়মানুবর্তিতায় প্রভাব পড়ে। অপেক্ষায় থাকা মানুষের সময় নষ্ট হয়। এসব প্রত্যক্ষ মামুলি কারণ সবার জানা। কিন্তু যে কারণগুলো মানুষের বিরক্তি তৈরিতে মৌলিকভাবে ভূমিকা রাখে, তা হয়তো কিছুটা পরোক্ষ এবং হয়তো আমরা জানিও। তবে তলিয়ে দেখি না।

কোথাও আপনার বিলম্বে উপস্থিতি মানে অন্যদের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং তাঁদের সময়ের ব্যাপারে আপনার অবহেলার প্রকাশ। বিশেষত তাঁরা যদি সামাজিক বা পেশাগতভাবে আপনার ঊর্ধ্বতন হন তাহলে তো কথাই নেই। আপনার বিলম্বের কারণ খুবই যৌক্তিক হতে পারে, হতে পারে এই দেরি হয়ে যাওয়াটা আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু বাস্তবতা যা–ই হোক না কেন, আপনার বিলম্ব তাঁদের প্রতি এমন একটি বার্তা ছুঁড়ে দেয় যে ‘আমার সময় আপনাদের সময়ের সময়ের চেয়ে অধিক মূল্যবান।’

অনেকেরই সময়ের হিসাব রাখতে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন

দেরি করার মনস্তাত্ত্বিক কারণ

আগেই বলা হয়েছে, আপনার দেরি মানে অন্যদের অপমান। কিন্তু সেই অপমান কি নিজেরও নয়! এর মধ্য দিয়ে তিনি দিনের পর দিন নিজেকেও অপমান-অসম্মান করে চলেছেন। ব্যক্তিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গ্রহণযোগ্যতা কমে যাচ্ছে। সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। এসব তো দৃশ্যমান। তারপরও কেন দেরি করে মানুষ? এটি কি কোনো মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা? হ্যাঁ, কারও কারও ক্ষেত্রে সমস্যা। অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার বা এডিএইচডি নামে একটি রোগ আছে। এতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অতিচঞ্চল ও অমনোযোগী হয়ে থাকেন। এ কারণে তাঁরা সময়ের হিসাব রাখতে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। কখন যেতে হবে, কতদূর যেতে হবে, কতটুকু সময় হাতে নিয়ে বের হওয়া উচিত—এসব বিষয়ে তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয়। পাংচুয়ালি চ্যালেঞ্জড বা সময়-প্রতিবন্ধীদের সাধারণ জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা বা ইচ্ছাশক্তিও থাকে দুর্বল পর্যায়ের।

তবে এসবের বাইরেও কতগুলো ‘ধোঁকাবাজ’ কারণ রয়েছে। এই ধোঁকা ব্যক্তি নিজেই নিজেকে দেন। কিছু কারণ মানুষের অন্তর্গত ক্ষোভ ও আগ্রাসী মানসিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত। আর কিছু কারণের উৎস ‘আত্মপ্রবঞ্চনা’।

আপনার আশপাশের মানুষদের মধ্যে যাঁরা সাধারণত সব কাজে দেরি করেন, তাঁদের দিকে লক্ষ করুন। নিজেরাই ব্যাপারটা ধরতে পারবেন। ভেতরে ক্ষোভ পুষে রাখা মানুষগুলো দৃশ্যত খুব শান্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে। স্বাভাবিক কাজকর্মে, আচার-আচরণে আগ্রাসী মনোভাবের প্রকাশ দেখা যায় না। কিন্তু সেই প্রকাশ ঘটে ভিন্ন উপায়ে। কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং বা আয়োজনে হয়তো তাঁর উপস্থিত হওয়ার কথা। অন্যরা তাঁর অপেক্ষায় বসে আছেন। কিন্তু তিনি আসবেন দেরিতে। পরোক্ষভাবে নিজের রাগ ঢালবেন তাঁদের ওপর। তাতে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়া যেমন নিজেকেই নিজে ফাঁকি দেওয়া, তেমনই এই দেরি করার অভ্যাস দিনশেষে নিজেরই ক্ষতি।

আবার নিজেকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভেবে দেরি করা লোকগুলো যে আত্মতুষ্টি অনুভব করেন, তা নিছকই আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু নয়। বাইরে নিজেকে বড় মনে করা মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভেতরে ভেতরে নিজেকে খুব ছোট, গুরুত্বহীন মনে করে। দেরি করার মধ্য দিয়ে তাঁরা তাঁদের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা ধরে রাখতে চান। অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চান।

তবে এই কারণগুলো ঢালাওভাবে সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। আপনার দেরি করার কারণ কী, খুঁজে বের করুন। নিজের মুখোমুখি দাঁড়ান। নিজেকে প্রশ্ন করুন, কেন আমার সবকিছুতে দেরি হয়ে যায়? কারণ, নির্ণিত হলে নিজেই খুঁজে পাবেন শোধরানোর পথ।

সাইকোলজি টুডে ডটকম অবলম্বনে