আধুনিক গাড়িগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালকের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। চালককে পরামর্শ দেয়, পথ দেখায়, সাবধান করে। এমনকি চালক চাইলে তাঁর দৈনন্দিন জীবনের কর্মকাণ্ড কিংবা অনুভূতির কথাও গাড়ির সঙ্গে ‘শেয়ার’ করতে পারেন। অর্থাৎ, এই যান্ত্রিক বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে করতে আপনি পথ পাড়ি দিতে পারবেন। গাড়ি ও মানুষের এই ‘সম্পর্ক’ গড়ে তোলা নিয়েই কাজ করছেন রাশেদ আল হাসান। রাশেদ বলেন, ‘যন্ত্র আমাকে কী বলছে, সেটা বোঝা আমার জন্য সহজ। কিন্তু আমি যন্ত্রকে কী বলছি, সেটা বোঝা তার জন্য কঠিন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে আমি ও আমার দল এই সমস্যা সমাধানে কাজ করছি।’
রাশেদের জন্ম কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে স্নাতক শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান জার্মানি। সেখানে বন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করার সময়ই অধ্যাপক ইয়েন্স লেমানের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। রাশেদের আগ্রহ ও দক্ষতা দেখে তাঁকে ইয়েন্সের পছন্দ হয়ে যায়। পিএইচডির প্রস্তাবটা তিনিই দেন। স্বাভাবিকভাবেই সুযোগটি লুফে নেন রাশেদ। শুরু হয় কথাবার্তা চালানোর উপযোগী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (কনভারসেশনাল এআই) নিয়ে গবেষণা। সে সময় পৃথিবীর অন্যতম বড় গবেষণাকেন্দ্র ফ্রাউনহফার ইনস্টিটিউটে গবেষক হিসেবে কাজ করতেন রাশেদ। মাত্র ২ বছর ৩ মাসেই শেষ হয় তাঁর পিএইচডির মূল কাজ। এরপরই ২০২২ সালের আগস্ট মাসে বিশ্বখ্যাত মোটরগাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিএমডব্লিউতে বৈজ্ঞানিক গবেষক (এআই এক্সপার্ট) হিসেবে যোগ দেন তিনি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা, অ্যালগরিদম ডিজাইন, সেগুলো আরও উন্নত করে গাড়িতে সংযোগ দেওয়া—পুরো কাজেই যুক্ত থাকেন রাশেদ। পাশাপাশি গবেষণা প্রকল্পে প্রযুক্তিগত অংশের পরিচালক তিনি। এর অংশ হিসেবে নিত্যনতুন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারণা তাঁকে তৈরি করতে হয়। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বিএমডব্লিউর প্রতিযোগী অন্যান্য জার্মান গাড়ির কোম্পানি, যেমন মার্সিডিস-বেঞ্জ, অডি, পোরশের অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত থাকতে হয়। রাশেদ জানান, বিএমডব্লিউতে গবেষণার কাজটি বেশ চ্যালেঞ্জিং।
বিএমডব্লিউর গবেষণা বিভাগে যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়—ইন্ডাস্ট্রি পর্যায়ে গবেষণার পূর্ব অভিজ্ঞতা, উচ্চতর একাডেমিক ডিগ্রি ও শীর্ষ বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে গবেষণাপত্র প্রকাশের অভিজ্ঞতা, কনভারসেশনাল এআই ও কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে গভীর ধারণা, সব শেষে জার্মান ভাষায় দক্ষতা। চারটির মধ্যে তিনটিতেই উতরে যান রাশেদ। এই তিন ক্ষেত্রে তিনি এতটাই এগিয়ে ছিলেন যে জার্মান ভাষায় দক্ষ না হয়েও বিএমডব্লিউর বৈজ্ঞানিক গবেষক হিসেবে নিয়োগ পান। কেবল ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেই এভাবে কাউকে নির্বাচন করে বিএমডব্লিউ, জানালেন রাশেদ। সঙ্গে যোগ করলেন, ‘যেহেতু ৯৫ ভাগের বেশি কর্মচারী জার্মানভাষী, তাই কর্মদক্ষতার পাশাপাশি জার্মান ভাষায়ও দক্ষতা লাগে। কেউ যদি বিএমডব্লিউতে কাজ করতে আগ্রহী হন, তাঁকে জার্মান ভাষা আয়ত্ত করে নেওয়ার পরামর্শ দেব।’
স্নাতকোত্তর করতে গিয়ে শুরুতে অবশ্য বেশ বিপাকেই পড়েছিলেন এই প্রকৌশলী। বন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের পাঠ্যক্রমে এমন অনেক বিষয় ছিল, যা স্নাতক পর্যায়ে তাঁর পড়া হয়নি। তাই গোড়া থেকে নিজেকে তৈরি করতে নিজ উদ্যোগেই বইপুস্তক পড়েছেন, অনলাইন ঘেঁটেছেন। আধুনিক ফলিত গণিত, সম্ভাব্যতা, পরিসংখ্যান এবং নতুন কম্পিউটারের ভাষা শিখতে তাঁকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।
এই দীর্ঘ যাত্রায় টার্নিং পয়েন্ট ছিল কোনটা? জানতে চাই রাশেদের কাছে। বললেন, ‘(স্নাতকে) আর দশটা কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্রের মতো সফটওয়্যার নিয়ে থিসিস না করে মেশিন লার্নিং নিয়ে থিসিস করাটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট, যেটা আমাকে পরবর্তী জীবনে গবেষক হতে সাহায্য করেছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের কোচ ড. মাহবুব আলম মজুমদারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন।’
দীর্ঘদিন জার্মান ইন্ডাস্ট্রিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করছেন এই গবেষক। নিজের অভিজ্ঞতাটা তিনি বাংলা ভাষার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নয়নের কাজে লাগাতে চান। ইতিমধ্যে সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছেন। বাংলাদেশের যেসব শিক্ষার্থী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী, তাঁদের নিয়ে ২০২২ সালে গঠন করেন ‘বাংলা এআই’। দলটি বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি বিভাগ আয়োজিত ‘এআই ফর বাংলা ২.০’ প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেছিল। ভবিষ্যতে বাংলা ভাষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশে আরও কাজ করার প্রত্যয় জানালেন এই তরুণ।এ্