কোনো কোনো শিক্ষকের আদর্শ আমরা জীবনভর বয়ে বেড়াই। অজান্তেই অনেক সময় সেই শিক্ষকের মতো হতে চাই। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এমনই প্রিয় একজন শিক্ষককে নিয়ে লিখেছেন গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর কুমারগাড়ী ১ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলমগীর খন্দকার
রোবন স্যার আমার হাইস্কুল জীবনের শিক্ষক। ক্লাসে আমাদের বায়োলজি পড়াতেন। আর ক্লাসের বাইরে? রচনা প্রতিযোগিতা থেকে কুইজ কমপিটিশন, খেলার মাঠ থেকে খেতখামার—গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের এক স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনি সব জায়গায় চষে বেড়াতেন।
তখন ২০০২ সাল। আমরা তালুক জামিরা দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে ক্লাস টেনে পড়ি। কৈশোরকালের প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল। আর্জেন্টিনার ইয়া বড় এক পতাকা এনে রোবন স্যার বললেন, স্কুলের সবচেয়ে বড় আমগাছের মগডালে বাঁশের খুঁটিতে টাঙাও। আমরা মহা হইচই করে পতাকা তুললাম। সেই প্রথম কোনো দলকে সাপোর্ট দিলাম। স্যার বললেন, ‘কাপ এবার আর্জেন্টিনাই নেবে।’
মনে আছে, স্যারের বাসায় মহা উৎসাহে কোয়ার্টার ফাইনাল দেখতে বসেছি। রান্নাঘর থেকে কাপের পর কাপ চা আসছে। কিন্তু বিশ্বকাপ আর এল না। আমাদের প্রিয় আর্জেন্টিনা ছিটকে গেল সুইডেনের সঙ্গে ড্র করে। সেদিন স্যারের আবেগ আর আমাদের কান্না মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্যার হতাশ হননি। বলেছিলেন, ‘দেখিস একদিন আমরাও...’
স্যার কখনো কোনো কাজে হতাশ হতেন না। কি কুইজ প্রতিযোগিতা, কি রচনায়। একবার আমরা পাশের স্কুলের ‘চিটিং’য়ের কারণে কুইজ প্রতিযোগিতায় হেরে গেলাম। মনোবল ভেঙে কয়েক টুকরা হয়ে গেল। স্যারের অনুপ্রেরণায় আমরাই পরে উপজেলা পর্যায়ে রচনা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হলাম। সম্মাননা পেলাম আমি।
শুধু খেলাধুলা বা এক্সট্রা কারিকুলারেই নয়, স্কুলের প্রশাসনিক পর্যায়েও স্যারের অবদান আছে। স্কুলে যেদিন হেডস্যার থাকতেন না, অঘোষিত প্রধান শিক্ষক থাকতেন রোবন স্যার। সহকারী প্রধান শিক্ষক একটু বেশি বয়সী হওয়ায় রোবন স্যারকেই স্কুলের দায়িত্ব দিয়ে যেতেন হেডস্যার। হেডস্যার নিজেই খুব কড়া ছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে রোবন স্যার ছিলেন আরও কড়া। পরে বুঝেছিলাম, এ জন্যই হেডস্যারের আস্থাভাজন ছিলেন তখনকার তরুণ এই শিক্ষক।
আমরা সেবার এসএসসির টেস্ট পরীক্ষা দিয়েছি। রেজাল্টও বেরিয়ে গেছে। স্কুলেই এক্সট্রা ক্লাস করছি। ফাইনাল পরীক্ষার আছে আর মাত্র তিন মাস! ঠিক তখন হঠাৎ জানতে পারলাম, স্যার উধাও। পরিবারসহ লাপাত্তা। কেউ খোঁজ পাচ্ছে না।
সেটা ২০০৩ সালের কথা, তখনই স্যার মুঠোফোন ব্যবহার করতেন। আমরা স্যারের নম্বরে কতবার যে কল করেছি, তিনি যদি জানতেন! প্রতিবার সেই রেকর্ড করা কণ্ঠস্বর—আপনি যে নম্বরে ফোন করেছেন, সেটি বন্ধ আছে।
আমরা ভাবতাম, স্যারের স্ত্রী বোধ হয় ফোন ধরে এসব বলছেন! তা ওনার স্ত্রী কি একবার স্যারকে বলতে পারেন না, তাঁর প্রিয় ছাত্ররা তাঁকে কীভাবে হন্যে হয়ে খুঁজছে? কতবার কল করছে!
পরে শুনেছি, দেনার দায়ে শিক্ষকতা ছেড়েছিলেন রোবন স্যার। স্কুলের সামান্য বেতনে আর চলছিল না। তাই ঢাকায় গিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছিলেন।
আমি নিজেও এখন শিক্ষক। ঢাকায় কয়েক বছর সাংবাদিকতা করে পলাশবাড়ী চলে এসেছি। কুমারগাড়ী ১ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতিনিয়ত রোবন স্যার (তাঁর ভালো নাম সাজ্জাত হোসেন চৌধুরী) হওয়ার চেষ্টা করছি। স্যার কি জানেন, আমার মতো তাঁর শেষ এসএসসি ব্যাচের ছাত্ররা এখনো তাঁকে কতটা মিস করে? শিক্ষকতায় তাঁর মতো মানুষ কতটা জরুরি?