আজ সকাল থেকেই বেশ কয়েকটি ছবি ভাইরাল। তাতে দেখা যাচ্ছে, সংসদ ভবন পরিষ্কার করছেন একদল স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষার্থী। আগের রাতে ভাইরাল ছবি আর ভিডিওতে দেখেছি, গণভবন ও সংসদ ভবন থেকে লুট হওয়া নানা জিনিস সংগ্রহ করে সেনাবাহিনীকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। অথচ গতকাল বিকেলে এই সংসদ ভবন ও গণভবনে দেখেছি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র।
সোমবার বেলা তিনটায় যখন মগবাজারের বাসা থেকে বের হই, তখন গলির মাথায় মাথায় মানুষের ভিড়। অনেকে যাচ্ছেন ‘আনন্দমিছিলে’, বাড়ির নারীরা বাচ্চাদের নিয়ে রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের দেখছেন। মানুষ স্লোগান দিয়ে, হাত নেড়ে, বুকে জড়িয়ে ধরে তাঁদের অভিবাদন জানাচ্ছেন। অনেকেই তখন ফেসবুক থেকে লাইভ করছেন। থেকে থেকে চিৎকার করে উঠছেন।
বাংলামোটর মোড়ের পদচারী–সেতুর ওপরে শত শত মানুষ। তাঁরা মিছিলে অংশ নেওয়া জনতাকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। রাস্তার দুই পাশ থেকে অনেকে পানি বিতরণ করছেন। অনেকে পানি ছিটাচ্ছেন। ফার্মগেট পর্যন্ত যেতে যেতেই দেখা গেল অন্য দৃশ্য। কারও মাথায় সোফা, কারও মাথায় গদি, কেউবা নিয়ে যাচ্ছেন প্লাস্টিকের চেয়ার। এত এত চেয়ার, সোফা—এর সবই সংসদ ভবন আর গণভবনের।
মিছিল যতই সংসদ ভবনের দিকে এগোচ্ছে, ততই বাড়ছে ভিড়। কেউ নিয়েছেন রেজিস্টার, কেউ শাক, কেউ মাছ, হাঁস, ছাগল, গাছ, ফুল, গাছের ডাল, পাতা ও মূর্তি। পরনে লুঙ্গি, গায়ে ময়লা শার্ট, পা খালি—একজন ‘টোকাই’ ধরনের লোকের হাতে বেঙ্গল টাইগারের দারুণ একটি মিনিয়েচার! মুঠোফোনে ছবি তুলতে গেলেই তিনি দৌড়ে পালালেন।
কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ফ্যান, এসি, লেপ, কাঁথা, কম্বল, শাল, চাদর, পেইন্টিং, শতরঞ্জি, পাপোশ, বালতি, বদনা, ট্রফি, কাগজপত্র, ফাইল, শোপিস, তৈজসপত্র, কুশন, ফুলের টব, গাছ, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি, হাঁস, বাল্ব, মাছ—কী নেই যা নিয়ে যাচ্ছেন না মানুষ! অনেকেই বড় বড় বাক্স মাথায় নিয়ে হাঁটছেন। সেসব বাক্সভর্তি শাড়ি! সংসদ ভবন এলাকায় সোফার ওপর রাজকীয় কায়দায় বসে ছবিও তুলেছেন অনেকে। কয়েকজন মিলে ফ্রিজ টেনে বেশি দূর নিয়ে যেতে না পেরে হতাশ হয়ে বাইরে ফেলে রেখে গেছেন। ফ্রিজের ভেতরের খাবার আর যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে গেছেন।
দুজন আবার একটি মাল্টিপ্লাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছেন। অনেকে শাড়ি ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। প্লেট, বাসনকোসন, আসবাব আর গাছ যাঁরা নিয়ে যাচ্ছিলেন, আশপাশের মানুষ চাইলে তাঁদেরও দিয়েছেন। বিকেল পাঁচটায় গণভবনের পুকুরে অনেকে মাছ ধরছিলেন। একজন আবার একটি পোশাক নিলামেও তুলেছেন। ‘পাঁচ শ, পাঁচ শ’ বলে চিৎকার করছেন। পাশ থেকে আরেকজন বললেন, ‘আরে মিয়া, রাইখা দেন। পরে অনেক টাকায় বেচতে পারবেন।’
ছয়টার দিকে খামারবাড়ির মোড়ে একজন এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপা, কিছু লাগবে? জামদানি শাড়ি? ঘর সাজানোর জিনিস? অনেক কিছু আছে।’ সারা ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে গণভবনের সবকিছু। অবস্থা এমন—সন্ধ্যায় কারওয়ান বাজার থেকে যখন বাজার করে ফিরছি, তখন পথে অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘আপা, ফুলকপি গণভবনের?’ ‘লাউ, মিষ্টিকুমড়া কি গণভবনের?’
যাঁরা এসব নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের দেখে অনেকেই বলছেন, ‘জনগণের মাল জনগণ নিয়ে যাচ্ছেন।’ একজনকে দেখলাম, তাঁর বাবার সঙ্গে গণভবনের টবসহ ফুলগাছ নিয়ে যাচ্ছেন। কথা বললাম। জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন, ‘মায়ের জন্য একটা জামদানি শাড়ি নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। শাড়ি কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। তাই এই ফুলগাছ নিয়ে যাচ্ছি। মাকে উপহার দেব।’
সন্ধ্যায় বাসায় এসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বরাতে জানা গেল, কিছু স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষার্থী গণভবন থেকে লুট হওয়া জিনিসপত্র সংগ্রহ করা শুরু করেছেন। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, অনেকে নিজেরাই এই স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘লুট’ করা জিনিসপত্র ফিরিয়ে দিয়েছেন। অনেকে ছাত্রদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লুট করা জিনিস রাতে আবার সংসদ ভবন এলাকায় রেখে গেছেন, ছাত্রদের বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। ছাত্ররা আবার সেগুলো সংগ্রহ ও জড়ো করে জমা দিয়েছেন সেনাবাহিনীর কাছে। শিক্ষার্থী স্বেচ্ছাসেবকেরা প্রায় ৫৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করে সেনাবাহিনীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এমন ছবি আর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
সংসদ ভবন এলাকা থেকে বের হওয়ার বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে তাঁরা গাড়ি থেকে জিনিসপত্র সংগ্রহ করেছেন। কে কী নিয়েছেন, সেই খোঁজও অনেকে দিয়েছেন। কোথায় সেগুলো রাখা আছে তা–ও দেখিয়ে দিয়েছেন। লুট হয়ে যাওয়া জিনিসপত্রের একটি অংশ ইতিমধ্যে সংগ্রহ করে আনা হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম।
এই লেখা যখন লিখছি, তখনো সংসদ ভবন অরক্ষিত। কেবল ঢাকা নয়, সারা বাংলাদেশ থেকে আগত নারী, শিশুসহ হাজার হাজার মানুষ সপরিবার ও দল বেঁধে ভিড় করছেন সংসদ ভবন আর গণভবন দেখার জন্য। তাঁদের অনেকে সফল, অনেককে আবার আটকে দিয়েছেন সেনাবাহিনী আর স্বেচ্ছাসেবকেরা। আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষার্থী আর সেনাবাহিনীর সদস্যরা মিলে সংসদ ভবন ও গণভবনে জনসাধারণের প্রবেশসহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। শিক্ষার্থী স্বেচ্ছাসেবকেরা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার কাজ করে চলেছেন। দিনের আলোয় প্রকাশ্যে লুট–ভাঙচুর হওয়া বিধ্বস্ত সংসদ ভবন ও গণভবনকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর প্রত্যয় নিয়ে কাজ করছেন তাঁরা।