ওয়াসিম আহম্মেদ আর তাহমিদ আল হাবিব। ফেব্রুয়ারিতে বইমেলার মৌসুমে এই দুই তরুণের সঙ্গে আপনারও হয়তো দেখা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিক থেকে বইমেলার যে ফটক, সেটা দিয়ে সোজা ঢুকে পড়লে হয়তো মিস করেছেন। তবে শ্রবণেন্দ্রিয়ের ওপর ভরসা রেখে কৌতূহল নিয়ে যাঁরা ডান দিকে পা বাড়িয়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এই দুই তরুণের কণ্ঠে শুনেছেন জীবনানন্দ দাশ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, নাজিম হিকমত বা পৃথ্বীরাজ চৌধুরীর কবিতা। কবিতাগুলো মহীনের ঘোড়াগুলি, হাতিরপুল সেশন, সহজিয়া, অঞ্জন দত্ত কিংবা অর্ণবের কোনো গানের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল।
এত ঘটা করে এই দুই তরুণকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মূল কারণ এই যে, কোলাহলপূর্ণ ঢাকা নগরীতে যেখানে পা ফেললেই পথ রোধ করে মোটরসাইকেল-রিকশা-অটোরিকশা অথবা ধাক্কা খেতে হয় পথচারীর সঙ্গে, কানে বাজতে থাকে শুধুই হর্ন ও সাইরেন, সেই শহরে দুজন গান ও কবিতার ছলে ফিরিয়ে এনেছিলেন হারাতে বসা এক পথশিল্পকে।
কেউ একে বলে ‘বাস্কিং’, কেউ ‘স্ট্রিট আর্ট পারফরম্যান্স’, আমরা বাংলায় বলতে পারি পথশিল্প। ব্যস্ত রাস্তার পাশে, কোনো পার্কে কিংবা লেকের ধারে আসন গেড়ে কোনো শিল্পকলা প্রদর্শন করাকেই বলে বাস্কিং। গান, মূকাভিনয়, পথনাট্য, স্কেচ বা ছবি এঁকে দেওয়া অথবা বানর খেলা দেখানো—সবই বাস্কিং! এর সঙ্গে অর্থযোগের সম্পর্কও আছে। বাস্কাররা বিভিন্ন শিল্প পরিবেশনের মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতাদের কাছ থেকে অর্থ সম্মানী পেয়ে বা নিয়ে থাকেন।
ওয়াসিম ঠাকুরগাঁয়ের ছেলে। গান গাইতে জানেন, ভালো গিটারও বাজান। কিন্তু গানকে পুঁজি করার ভাবনা তাঁর কখনোই ছিল না। বাস্কিং নিয়ে আগ্রহের শুরু কোথা থেকে জানতে চাইলে ওয়াসিম বললেন, ‘বাস্কিং ব্যাপারটা অন্য রূপে আমাদের দেশে বহু আগে থেকেই আছে। গ্রামগঞ্জে একসময় বাউলরা যেমন গান শোনাত। কিন্তু আজকাল বাউলরা এলেও দেখা যায়, গান গাওয়া শেষে কোনো মলম বা ওষুধের বিজ্ঞাপন নিয়ে এসেছে, যা আসলেই দুঃখজনক। স্ট্রিট আর্ট পারফর্ম নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করার পরেই মূলত বাস্কিং ব্যাপারটার সঙ্গে পরিচিত হই।’
২০২০ সালে প্রথম গিটার নিয়ে পথে নামেন ওয়াসিম। তবে তখনো সঙ্গে ছিল না কোনো মাইক্রোফোন বা অ্যামপ্লিফায়ার। তাই ঢাকার শান্ত, তুলনামূলক কম কোলাহলপূর্ণ স্থানগুলোকেই বেছে নিয়েছিলেন। ২০২২ সালে সিদ্ধান্ত নেন, ২০২৩-এর বইমেলায় আবার বাস্কিং শুরু করবেন, মানুষকে এ শিল্প সম্পর্কে জানাবেন। পরে কবিতা নিয়ে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন তাহমিদ। দুই বন্ধু মিলে একটি জমজমাট আয়োজন গড়ে তোলেন, নাম দেন ‘গান ও কবিতা’।
সন্ধ্যা সাতটা বাজলেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গান ও কবিতার ‘ফিউশন’ নিয়ে হাজির হতেন তাঁরা। তাঁদের পরিবেশনায় উঠে আসে শান্তি, সুখ, দুঃখ, ক্লান্তি, ক্ষোভ কিংবা যুক্তির কথা। দুই শিল্পী পাশে রাখেন একটা ঝুড়ি, তাতে টাকার পাশাপাশি চিরকুট, ফুল, বইও দিয়ে যান পথচারীরা।
বাস্কিং নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা অম্ল-মধুর। কখনো মিলেছে পথচারীদের বাহবা, কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তিরস্কার। তাহমিদের মতে, বাস্কিং একধরনের শিল্প, আর শিল্প কখনোই বেআইনি হতে পারে না।
পৃথিবীর এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে বাস্কিংয়ের জন্য শিল্পীদের আলাদা করে ‘অডিশন’ দিতে হয়। বিশেষ করে বেলজিয়াম, সিঙ্গাপুর ও ইংল্যান্ডে একরকম অডিশনের মাধ্যমে নির্বাচিত হন বাস্কাররা। এরপরই মেলে পথে নামার অনুমতি। আবার যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও থাইল্যান্ডের মতো দেশে বাস্কিংয়ের জন্য আলাদা করে অনুমতির প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু দুবাইয়ের মতো শহরে বাস্কিং আবার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
বাস্কিং করার আগে তাই অবশ্যই পারিপার্শ্বিক ও আর্থসামাজিক অবস্থা মাথায় রাখা উচিত। সমুদ্রতটে বালুবেলায় যে গান শুনতে মিষ্টি মধুর লাগবে, সেই একই গান নগরীর কর্মব্যস্ততায় আশপাশের মানুষের বিরক্তির কারণও হতে পারে।