স্ত্রী আমার বাড়িতে আসবে না বলে জানিয়েছে

পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার

মিতি সানজানা

প্রশ্ন: আমি একজন পুরুষ। ২০২৩ সালের ২ জুন আমার বিয়ে হয়েছে। আমার স্ত্রী শ্বশুরবাড়িতেই থাকে। এযাবৎ নিয়মিত শ্বশুরবাড়ি আসা–যাওয়া করেছি। অনেকবার স্ত্রীর কাছে নির্যাতনেরও শিকার হয়েছি। স্ত্রী আমার বাড়িতে আসবে না বলে জানিয়েছে। একাধিকবার কথা বলেও কোনো লাভ হয়নি। ভেবেছিলাম, তালাক দেব। তবে সে জানিয়েছে, তালাক দিলে মিথ্যা মামলা করবে। এখন আমার করণীয় কী?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

উত্তর: বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার আছে। ‘নারী ও শিশু নির্যাতন আইন’ নারী ও শিশুদের সুরক্ষার জন্য একটি বিশেষ আইন। পুরুষদের জন্য কোনো বিশেষ আইন নেই। আপনি জানাননি যে আপনার স্ত্রী আপনাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে কি না। যেকোনো ব্যক্তির দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত হলে দেশের অন্যান্য আইনে আশ্রয় গ্রহণ করার পরিপূর্ণ অধিকার আপনার আছে। যেকোনো মানুষের বিচার চাওয়া ও বিচার পাওয়া একটি সাংবিধানিক অধিকার। কাজেই আপনি যদি আপনার স্ত্রীর দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার উচিত হবে নিকটস্থ থানায় গিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা।

এ ছাড়া আপনার স্ত্রীর কারণে পারিবারিক বা সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হওয়া, কোনো কলহ-বিবাদ তৈরির আশঙ্কা কিংবা বিরক্তিকর কোনো কাজের শঙ্কা দেখা দিলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চাইতে পারেন। দণ্ডবিধির ধারা ৩২৩-এ স্বেচ্ছাকৃত আঘাতদানের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এখানে বলা আছে, কেউ যদি স্বেচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করে, তার শাস্তি হবে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড। আপনি এসব অপরাধের শিকার হয়ে থাকলে আপনার স্ত্রীর বিরুদ্ধে এই আইনের অধীনে প্রতিকার চাইতে পারবেন।

এবার মিথ্যা মামলা প্রসঙ্গে আসা যাক। আপনি জানিয়েছেন, তালাক দিতে চাইলে আপনার স্ত্রী আপনাকে মিথ্যা মামলা করবে বলে হুমকি দিচ্ছে। স্ত্রী যদি আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেন, তবে আপনাকে প্রথমে জানতে হবে মামলাটি থানায় নাকি আদালতে হয়েছে। এরপর আইনজীবীর মাধ্যমে মামলার আরজি বা এজাহারের কপি তুলতে হবে। এরপর আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে মামলাটির ধারা জামিনযোগ্য কি না। যদি তা জামিনযোগ্য হয়, তবে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে পারবেন।

অভিযোগ জামিন অযোগ্য হলে উচ্চ আদালতে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে আগাম জামিনও চাইতে পারবেন। তবে হাইকোর্ট বিভাগ আগাম জামিন সাধারণত নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত দিয়ে থাকেন। এ মেয়াদের মধ্যেই নিম্ন আদালতে গিয়ে জামিননামা সম্পাদনের জন্য আবেদন করতে হবে। আদালতে বিচার চলাকালে নির্দিষ্ট তারিখে উপস্থিত থেকে হাজিরা দিতে হবে।

সাধারণত পুলিশ প্রতিবেদন হওয়ার আগেই জামিন চাইতে হয়। পুলিশ অভিযোগপত্র দাখিল করার আগে উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের মাধ্যমে অভিযোগটি যে মিথ্যা, তা প্রমাণ করার চেষ্টা করতে পারেন। থানায় তদন্তকারী কর্মকর্তা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগটির সত্যতা না পেলে আপনাকে নির্দোষ দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন বা ফাইনাল রিপোর্ট আদালতে দাখিল করবেন। অভিযোগপত্র দাখিল হয়ে গেলে মামলাটি বিচারিক আদালতে বদলি করা হয়। অভিযোগ গঠনের দিন আসামিকে হাজির হয়ে নতুন করে পূর্বশর্তে জামিন চাইতে হবে এবং জামিননামা সম্পাদন করতে হবে। এই আবেদনে আসামি মামলা থেকে অব্যাহতি চাইতে পারেন। অব্যাহতির আবেদন নাকচ হলে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন তিনি।

মিথ্যা মামলা হওয়ার পর যদি পুলিশ এসে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়, তবে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করতে পারবেন। যদি আদালত জামিন দেন, তাহলে একজন পরিচিত জামিনদারের জিম্মায় আসামিকে জামিননামা সম্পাদন করতে হবে। যদি জামিন না হয়, তাহলে পর্যায়ক্রমে উচ্চ আদালতে আবেদন করতে হবে।

যদি থানায় না হয়ে আদালতে মামলা (সিআর মামলা) হয়, তাহলে আদালত সমন জারি করতে পারেন কিংবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে হাইকোর্ট বিভাগে আগাম জামিন চাইতে পারেন।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত)–এর ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কারও ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

তা ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারায় মিথ্যা মামলার শাস্তির বিধান রয়েছে। এই ধারায় বলা আছে, ম্যাজিস্ট্রেট যদি আসামিকে খালাস দেওয়ার সময় প্রমাণ পান যে মামলাটি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বাদীকে কারণ দর্শানোর নোটিশসহ ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন। দণ্ডবিধির ১৯১ থেকে ১৯৬ ধারা পর্যন্ত মিথ্যা সাক্ষ্যদান, মিথ্যা সাক্ষ্য সৃষ্টি ও মিথ্যা সাক্ষ্যদানের শাস্তি সম্পর্কে বলা আছে।

আপনার স্ত্রীর এ ধরনের হুমকি ও আচরণের কথা উল্লেখে আপনি নিকটস্থ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে রাখতে পারেন।