প্রেমের বিয়েতে পরস্পরের প্রতি প্রত্যাশা থাকে বেশি। অনেক সময় পরিবারকে বিয়েতে রাজি করাতেও সমস্যায় পড়েন যুগলের অন্তত একজন। যাঁর জন্য নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করলেন, তাঁর কাছ থেকে কষ্ট পেলে সেটা মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
সারা জীবন একসঙ্গে চলবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে যে দুজন মানুষ প্রেম করলেন ৫ বা ১০ বছর, বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় কেন ভেঙে গেল সেই প্রতিজ্ঞা? দীর্ঘদিনের জমজমাট প্রেম। হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেরই আলোচিত জুটি। ছয়-সাত বছরের প্রেম বিয়েতে গড়াতে না গড়াতেই সম্পর্কে ধরে ভাঙন। কিন্তু কেন? বিয়ের মতো সামাজিক বন্ধনে একটি সম্পর্ক পূর্ণতা পাওয়ার কথা, ভালো লাগা আর ভালোবাসার মুহূর্তগুলো রঙিন হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু অতঃপর তাহারা আর সুখে-শান্তিতে বাস করিতে পারিল না কেন?
ভালোবেসে বিয়ে করার অল্প কিছুদিনের মাথায় প্রেমিক আর স্বামী হিসেবে একই মানুষের আচরণের বিস্তর ফারাক আবিষ্কার করে হতভম্ব হয়ে যান কোনো নারী। স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের ঘটনা থেকে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। আবার এমনও হতে দেখা যায়, একজন পুরুষ তাঁর প্রিয়তমা প্রেমিকার একটু সঙ্গলাভের জন্য বিয়ের আগে জানটা কোরবান করে দিতে চাইলেও বিয়ের পর তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গ তাঁকে বিরক্ত করে তুলছে। বিয়ের আগের নিজস্ব জীবনধারাকে হঠাৎ হারিয়ে ফেলে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারেন তিনি। কিন্তু এমন ঘটনা কেন ঘটে? কারণ এবং এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে করণীয় সম্পর্কে জানালেন ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. রশিদুল হক।
অতিরিক্ত প্রত্যাশা
প্রেমের বিয়েতে পরস্পরের প্রতি প্রত্যাশা থাকে বেশি। অনেক সময় পরিবারকে বিয়েতে রাজি করাতেও সমস্যায় পড়েন যুগলের অন্তত একজন। যাঁর জন্য নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করলেন, তাঁর কাছ থেকে কষ্ট পেলে সেটা মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। প্রত্যাশা পূরণের সামান্য ঘাটতিও বড় মনে হয়। তাই বলে বসেন, ‘তোমার কাছে এটা আশা করি নাই।’
বাস্তবতার ভাবনা থেকে দূরে
কাউকে ভালোবাসলে কেবল তাঁর ইতিবাচক দিকগুলোই চোখে পড়ে। কিন্তু প্রত্যেক মানুষেরই কোনো না কোনো মন্দ দিক থাকে, যা বিয়ের পর অর্থাৎ সার্বক্ষণিক সঙ্গী হওয়ার পর চোখে পড়ে। আর্থিক বা সামাজিক বিষয়গুলোও অনেকে বিয়ের আগে খতিয়ে দেখেন না। প্রেমিকার রান্নাবান্না নিয়ে অনেক পুরুষই মাথা ঘামান না, কিন্তু বিয়ের পর কেউ তাঁর মাথায় এটা ঢুকিয়ে দিতে পারে, ‘তোমার বউ তো রান্নাই জানে না। তোমাকে খাওয়াবে কী?’ উল্টোটাও ঘটে। স্ত্রীকে শুনতে হতে পারে, ‘তোমার জামাই তো ছোটখাটো একটা চাকরি করে। তোমাকে খাওয়াবে কী?’
পরিচিত কেউ জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে দামি উপহার পাচ্ছেন, কিংবা দেশের বাইরে বেড়াতে যাচ্ছেন তাঁরা, এদিকে নিজের এত বছরের প্রেমিকের কাছ থেকে তেমন উপহার বা ‘সারপ্রাইজ’ পাচ্ছেন না, এমন ভাবনায় হতাশা ভর করতে পারে মনে। প্রেম করার সময় হয়তো দুজনেই শিক্ষার্থী ছিলেন। বিয়ের পর চাকরির জীবনটা দাঁড় করাচ্ছেন। সেই সময়টুকু দেওয়ার মানসিকতা না থাকলে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারেন কেউ। কেউ আবার পরিবারের সমর্থন হারিয়ে আর্থিক সংকটেও পড়েন। দম্পতির একজন আধিপত্য বিস্তার করতে চাইলে সেটিও অপরজন মানতে পারেন না।
মিথ্যা আশ্বাস
বিয়ের পর একজন নারী তাঁর কর্মস্থল, কর্মঘণ্টা, অফিস ট্যুর কিংবা উচ্চশিক্ষা—অনেক কিছু নিয়েই বাধার মুখে পড়তে পারেন। বিয়ের আগে হয়তো পূর্ণ স্বাধীনতার আশ্বাস ছিল, কিন্তু পরে পরিবারের চাপে বদলে যান কিছু পুরুষ। কিংবা ‘ইগো’ অর্থাৎ অহংয়ে আঘাত লাগায় এমনটা করেন। স্ত্রী উচ্চমর্যাদার চাকরি করলে বা স্ত্রীর উপার্জন বেশি হলে অনেক পুরুষ মেনে নিতে পারেন না। অনেকে আবার বিয়ের আগে তাঁর আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে মিথ্যাও বলেন। সম্পদের লোভ থাকলে সেটিও বেরিয়ে আসে বিয়ের পর।
অবিশ্বাস
প্রেমে জন্মায় অধিকারবোধ। বিয়েতে সেই বোধ পূর্ণতা পায়। বিয়ের পর একজন নারী তাঁর পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে বাধা পেতে পারেন, বিশেষত সেই বন্ধুরা যদি হন পুরুষ। একই ধরনের বাধা পেতে পারেন পুরুষও। বিপরীত লিঙ্গের পুরোনো বন্ধুর অতীতের ভালো লাগা কিংবা কম বয়সের ভুল হঠাৎ সামনে এসে যাওয়াতেও বিশ্বাসে চিড় ধরতে পারে।
পারিবারিক আরও দিক
আজও বাংলাদেশের অনেক পরিবার প্রেমের বিয়ে মেনে নিতে পারে না। নিমরাজি হয়ে বিয়ে দিলেও পরিবারের এই নতুন সদস্যটির সঙ্গে পরবর্তী সময়ে নেতিবাচক আচরণ করেন। এই আচরণ প্রভাব ফেলতে পারে নবদম্পতির ওপর। ‘তুমি আমার মা-বাবার কথা শুনলে না কেন’–জাতীয় প্রশ্নে যে কারোরই অভিমান হতে পারে। নিজের পরিবারের সদস্যরা স্ত্রীর খুঁত ধরলেও পারিবারিক শান্তির কথা ভেবে চুপ থাকেন অনেক পুরুষ। এতেও জমে অভিমানের মেঘ। আগে পরস্পরের মান-অভিমানকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হতো, এমন পরিস্থিতিতে সেই গুরুত্বটাও হারিয়ে যেতে পারে।
পরিত্রাণ
সব প্রেমের বিয়েই যে দ্রুত বিচ্ছেদের দিকে যায়, তা কিন্তু না। যাঁরা ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বটাকেও নিজের করে নেন, তাঁরা কিন্তু দিব্যি সংসার করেন। ছোট ছোট অনেক কারণেই বিচ্ছেদ ঘটতে পারে, চাইলেই যেগুলোর সমাধান সম্ভব—
সম্পর্কে চিড় ধরলে নিজেদেরই উদ্যোগী হতে হবে। শান্তিপূর্ণ আলোচনা করতে হবে। জীবনে যতই ঝড় আসুক, একে অন্যের ভরসাস্থল হয়ে উঠতে হবে।
ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। যাঁর জন্য আগেও ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাঁকে নিয়েই তো আপনার ভবিষ্যৎকে সাজাতে চেয়েছেন। তাঁর চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দিন। সাময়িক আর্থিক সংকটে থাকলে সঙ্গীকে সেটা নিঃসংকোচে জানান। জানিয়ে রাখুন, কঠিন দিনগুলোও আপনি তাঁকে সঙ্গে নিয়েই পেরোতে চান। ভালোবাসা দিয়ে আর্থিক অসংগতি পুষিয়ে নিন।
সঙ্গীর প্রতি নেতিবাচক আচরণ করবেন না। তাঁকে সমর্থন দিন, সময় দিন। অবহেলা করবেন না।
পরিবার, আত্মীয়, প্রতিবেশী, এমনকি কাছের বন্ধুরাও যদি জীবনসঙ্গীর বিরুদ্ধে কথা বলেন, অবশ্যই ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলাতে হবে। কারও সঙ্গে তর্কে জড়ালে পরিস্থিতি আরও বিরূপ হয়ে পড়তে পারে। নিজের মনে সব সময় এই বোধটা রাখুন, যাঁকে আপনি ভালোবাসেন, তাঁর কাছে জগৎ–সংসার তুচ্ছ। দোষে-গুণে মিলিয়েই মানুষ। এই মানুষটাকেই আপনি ভালোবেসেছেন। আর আপনিও দোষ-গুণের ঊর্ধ্বে নন। পারিবারিক অশান্তির মুহূর্তে সঙ্গী এবং পরিবারের বাকি সদস্যের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করুন।