যুক্তরাজ্যের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার লাইফস্টাইল বিভাগে নিচের প্রশ্নটি পাঠিয়েছিলেন একজন নারী পাঠক। প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছিলেন কলাম লেখক অ্যানালিসা বারবেইরি। প্রশ্নটি হলো, ‘বয়ফ্রেন্ড বা প্রিয়জনের সঙ্গে যখন তর্ক বা ঝগড়া হয়, তখন আক্ষরিক অর্থেই আমি কোনো কথা বলতে পারি না। কী করতে পারি?’
প্রশ্ন: আমি যুবতী। তর্ক করতে আমার খুব সমস্যা হয়, বিশেষ করে বয়ফ্রেন্ড কিংবা ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গে। সামাজিক এবং পেশাগত জীবনে আমি মিশুক, স্পষ্টবাদী, উপস্থিতবুদ্ধিসম্পন্ন, আড্ডাবাজ ও বন্ধুসুলভ। এমন না যে আমি মানুষের সামনে কথা বলতে গেলে নার্ভাস হয়ে যাই। আমি নিয়মিতই বিপুলসংখ্যক দর্শক-শ্রোতার সামনে বক্তব্য দিই। সুন্দরভাবে কথা বলার জন্য প্রায়ই প্রশংসা কুড়াই। অফিসে বা কোনো পার্টিতে আমার নিজের মতামত তুলে ধরতে কোনো সমস্যা হয় না।
এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। অনেক সম্ভাবনাময় সম্পর্ক এভাবেই শুরু হয়েছিল। যাহোক, সম্পর্কে যখন কোনো টানাপোড়েন শুরু হয়, প্রেমিকের সঙ্গে একান্তে কোনো কথা কাটাকাটি হলে, যত তুচ্ছ বিষয়েই হোক, আমি কথা বলতে পারি না। পাল্টা জবাব হিসেবে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত উত্তরটা একদম গোছানো অবস্থায় আমার মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে। কিন্তু মনে হয়, আমি যেন বোবা হয়ে গেছি!
মনে হয়, আমি যদি একটা শব্দও বলি, তাহলে কান্নায় ভেঙে পড়ব। কান্না আর থামতে চাইবে না। প্রায়ই কেঁদেও ফেলি। পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে যাই। শেষ পর্যন্ত আমার বেচারা প্রেমিক বলে, ‘কী হলো? কিছু একটা তো বল!’ মাঝেমধ্যে রাগ করে সে চলেও যায়।
বলে বোঝানো সম্ভব না ব্যাপারটা আমার প্রেমিক ও আমার জন্য কতটা হতাশার। নিজেও বুঝতে পারি না, এই কথা না বলতে পারা রোগ আমার হলো কীভাবে! প্রায় একই ধরনের (একটু কম) সমস্যায় পড়ি, যখন আমার মা-বাবার সঙ্গে তর্ক বাধে। অবশ্য তাদের সঙ্গে আমার বেশি একটা কথা–কাটাকাটি হয় না।
উত্তর: আপনার সমস্যাটা নিয়ে আমি মনোবিদ লিন গ্যাব্রিয়েলের (ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর কাউন্সেলিং অ্যান্ড সাইকোথেরাপির একজন মনোবিদ) সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আমরা দুজনই আপনার শেষ লাইনটিতে আটকে গিয়েছি। বাজি ধরে বলতে পারি, আপনার এই সমস্যার সঙ্গে ছেলেবেলায় আপনি যেভাবে বেড়ে উঠেছেন, তার একটা সম্পর্ক আছে। সম্ভবত পরিবারের কোনো একজন সদস্যের (হতে পারে তিনি আপনার মা-বাবা কিংবা ভাই-বোন) সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করা আপনি শেখেননি। হয়তোবা সেই মানুষটি কোনো ভিন্নমত সহ্যই করতে পারতেন না কিংবা খুব বেশি ভেঙে পড়তেন।
কোনো এক পর্যায়ে আপনি নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে নিজের একটি কৃত্রিম সত্তা তৈরি করতে শিখে গেছেন, যে সত্তা খুব সহজেই বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। ঘরোয়া পরিবেশে, যেখানে মতবিরোধ থাকে, সেখানে অনেকেই নিজের পরিণত সত্তাকে প্রকাশ করতে পারে না। কথা বলতে গিয়ে অনেকেই আবেগপ্রবণ হয়ে যায়, কথাগুলো ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারে না। আমাদের আচরণ একেক মানুষের সঙ্গে একেক রকম হয়। দেখা যায়, অনেকেই কর্মক্ষেত্রে খুব দাপটের সঙ্গে কাজ করেন, কিন্তু বাসায় তারা অত্যন্ত ঠান্ডা স্বভাবের।
তাহলে কী করণীয়? গ্যাব্রিয়েলের প্রথম পরামর্শ হলো, রেবেকা ক্রেনের লেখা ‘মাইন্ডফুলনেস-বেজড কগনিটিভ থেরাপি’ বইটি পড়া। আপনার সমস্যাটি তিনি খুব একটা জটিল মনে করেন না। যদি আপনি থেরাপি নিতে চান, সে ক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শ হলো, ‘মাইন্ডফুলনেস-বেজড থেরাপি’ নেওয়া। আপনি এখন কেমন, আর ভবিষ্যতে কেমন হতে চাইছেন, সে ব্যপারে থেরাপিস্টের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করুন। তারপর আপনি বুঝতে পারবেন কীভাবে নিজের মধ্যে এই পরিবর্তন আনা সম্ভব। পরিবর্তন তো আর এক দিনে হবে না, সময় লাগবে। এখন প্রশ্ন হলো, এই সময়টুকুতে আপনি কী করবেন?
ধরা যাক, কথা-কাটাকাটির সময় আপনি যা বলতে চাইছেন, তা বলতে পারছেন না; এমন অবস্থায় আপনি বলতে পারেন, ‘আমি এখন এই কথার কোনো উত্তর দেব না। কিন্তু পরে দেব।’ কিংবা বলুন, ‘আমি এ ব্যাপারে এখন কিছু বলতে পারব না। পরে বলব।’ এ রকম কিছু বাক্য ঠিক করে ফেলুন এবং প্রয়োজনের সময়ে সেসবই বলুন। কথাগুলো বলার প্র্যাকটিস করুন। চাইলে লিখেও রাখতে পারেন। উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের সময় লেখাটি আপনার বয়ফ্রেন্ড বা পরিবারের সদস্যদের দেখান। আশা করা যায়, অপর ব্যক্তিটি আপনার এই সিদ্ধান্তকে সম্মান করবে।
যতক্ষণ না আপনি নিজের এই আচরণের পেছনের কারণ খুঁজে পাচ্ছেন, ততক্ষণ ব্যাপারটাতে আরেকটু সময় দিলে উপকার পেতে পারেন। কোনো কিছু নিয়ে কারও সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হলে ঘটনার পর যখন পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যাবে, তখন ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটি নিয়ে আবার কথা বলুন। সেই সময় আপনার মতামতটি জানিয়ে দিন।
আশা করি, আপনি একদিন প্রিয়জনদের সামনে কারও সাহায্য ছাড়াই নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে সক্ষম হবেন।
সুত্র: দ্য গার্ডিয়ান