প্রিন্সেস না হয়েও রাজপরিবারের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রিন্সেস আর কেউ নন, প্রিন্সেস ডায়ানা। সবকিছু ঠিক থাকলে এটা হতে পারত ডায়ানার পূর্ণ রানি হওয়ার দিন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় ১৯৯৫ সালে। এমনিতেই তখন আলাদা থাকছিলেন ডায়ানা আর প্রিন্স চার্লস। সেই সময় ডায়ানা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে মনে আটকে রাখা গুমোট সত্যটাকে বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়ে মানসিক ভার অনেকটাই লাঘব করেছেন। বলেছেন, ‘ওয়েল, দেয়ার ওয়াজ থ্রি অব আস ইন দিস ম্যারেজ, সো ইট ওয়াজ আ বিট ক্রাউডেড (এই বিয়েতে আসলে মানুষ আমরা তিনজন, এজন্যই একটু জনাকীর্ণ আর কী)।’ রানি এলিজাবেথ এমনিতে সন্তানদের ব্যক্তিগত কোনো সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করেননি। কিন্তু এই সাক্ষাৎকারের পর আর চুপ থাকতে পারেননি। দুজনকে আলাদা করে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, ‘তোমাদের সামনে কেবল একটা রাস্তাই খোলা, বিচ্ছেদ।’
‘প্রতিশোধ নিতে’ চার্লসের সঙ্গে প্রেম শুরু করেছিলেন ক্যামিলা
ক্যামিলা পার্কার ও ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা অ্যান্ড্রু পার্কারের প্রথম দেখা ১৯৬৫ সালে। ক্যামিলার তখন ১৮ বছর বয়স। এই দুজনের সম্পর্ক ছিল অনেকটা ‘অন অ্যান্ড অফ’। ক্যারোলিন গ্রাহামের ‘ক্যামিলা অ্যান্ড চার্লস: দ্য লাভ স্টোরি’ বইতে বলা হয়েছে, ক্যামিলার সঙ্গে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় অ্যান্ড্রু একাধিক প্রেম করেছেন। এর মধ্যে ক্যামিলার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীও ছিলেন। এরপর রাজকন্যা অ্যানের সঙ্গেও প্রেম শুরু করেন অ্যান্ড্রু। রাজকন্যা অ্যান রানি এলিজাবেথের একমাত্র কন্যা। এটা দেখে ‘প্রতিশোধপরায়ণ’ হয়ে রানির বড় ছেলে প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে প্রেম শুরু করেন ক্যামিলা। ১৯৭০ সালে ক্যামিলাকে প্রথম দেখেছিলেন চার্লস। প্রথম দেখায় আত্মবিশ্বাসী ক্যামিলার প্রেমে পড়েন চার্লস। প্রায় ১৮ মাস চলেছিল তাঁদের প্রেম।
এরপর চার্লস রয়্যাল নেভির প্রশিক্ষণ নিতে চলে যান ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। এদিকে প্রিন্সেস অ্যান প্রত্যাখ্যান করেন অ্যান্ড্রুকে। এ সময় অ্যান্ড্রু বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ফিরে আসেন ক্যামিলার কাছে। এদিকে ক্যামিলাকে বোঝানো হয়েছিল, রাজপরিবারের কড়া নিয়ম আর রক্ষণশীলতা মেনে রাজবধূ হওয়ার যোগ্যতা তাঁর নেই। আর রাজবধূ হতে গেলে তাঁর সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কেননা, উভয় প্রেমিকের সঙ্গেই তিনি ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন।
চার্লস তাঁকে যথেষ্ট ভালোবাসতেন। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার মতো সাহস তাঁর ছিল না। কেননা চার্লস জানতেন, ক্যামিলাকে মেনে নেওয়া রাজপরিবারের জন্য কঠিন। এ জন্য তিনি সময় নিচ্ছিলেন। সবটা বুঝে অ্যান্ড্রুকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যান ক্যামিলা। আর সে কথা চার্লসকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেন। বিয়ের কয়েক দিন আগেও সেই বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্য ক্যামিলাকে অনুরোধ করেন চার্লস। ১৯৭৩ সালে অ্যান্ড্রুর সঙ্গে ক্যামিলার বিয়ে হয়ে যায়। সেই বিয়েতে রাজকীয় অতিথিদের মধ্যে রানির বোন, রাজকুমারী মার্গারেট এবং অ্যান্ড্রুর সাবেক প্রেমিকা রাজকুমারী অ্যানও উপস্থিত ছিলেন।
‘আই ওয়ান্ট মাই হাজবেন্ড’
বিয়ের পরও চার্লসের সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যান ক্যামিলা। চার্লস সেই সম্পর্কের নাম দিয়েছিলেন ‘গভীর, শুদ্ধ বন্ধুত্ব’। ডায়ানাও শুরুতে ক্যামিলাকে সেভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ‘উইমেনস ইন্সটিঙ্কট’–এ ধরা পড়ে যান ক্যামিলা। চার্লস আর ক্যামিলার মধ্যে কী চলছে বুঝতে সময় লাগে না ডায়ানার। তাই ১৯৮১ সালে চার্লস আর ডায়ানার বিয়েতে ক্যামিলার উপস্থিতি অস্বস্তি বাড়িয়েছিল ডায়ানার। তত দিনে ক্যামিলা ও অ্যান্ড্রুর দুই সন্তান হয়েছে। রাজকীয় বিয়ের পরও ক্যামিলাকে ভুলতে পারেননি চার্লস। এমনকি ডায়ানা আর চার্লসের দুই সন্তান হওয়ার পরও।
ডায়ানা আর চার্লসের ব্যক্তিত্ব ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। চার্লসের রাশভারী চরিত্রের সঙ্গে ডায়ানার উচ্ছ্বল ও বহির্মুখী চরিত্রের সংঘাত বাধত প্রায়ই। রাজপরিবারের নানা নিয়মের বেড়াজাল ডিঙিয়ে ‘জনগণের রানি’ হয়ে ওঠাকে রানি এলিজাবেথও ভালোভাবে নেননি। কেননা সে সময় ডায়ানা ছিলেন রাজপরিবারের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। আর সেই ব্যক্তিত্বের ছটায় রাজপরিবারের আর সবাই, আর সমস্ত কর্মকাণ্ড যেন ম্লান হয়ে পড়ছিল। এ ছাড়া জনমতকে নিজের পক্ষে টানার অপূর্ব ক্ষমতা ছিল ডায়ানার। বিয়ের আগেও একাধিকবার দেখা হয়েছে ক্যামিলার সঙ্গে। ‘ডায়ানা: হার ট্রু স্টোরি ইন হার ওন ওয়ার্ড’ বইতে অ্যান্ড্রু মর্টন জানিয়েছেন, বিয়ের চার বছর পর ১৯৮৫ সালে একটি পার্টিতে দেখা হয় ডায়ানা ও ক্যামিলার।
ক্যামিলাকে দেখেই ডায়ানা বলেছিলেন, ‘আই নো হু ইউ আর। ডোন্ট ট্রিট মি লাইক অ্যান ইডিয়ট’ (আপনি কে আমি জানি, আমাকে বোকা ভাববেন না)। শুনে ক্যামিলা বলেছিলেন, ‘ইউ আর দ্য ওয়াইফ অব দ্য মোস্ট ডিজায়ারেবল পারসন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। ইউ আর দ্য প্রিন্সেস অব ওয়েলস। ইউ হ্যাভ টু বিউটিফুল কিডস। হোয়্যাট ডু ইউ ওয়ান্ট মোর (বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মানুষটার আপনি স্ত্রী। আপনি প্রিন্সেস অব ওয়েলস। আপনার সুন্দর দুটো বাচ্চা আছে। আর কী চান)?’ উত্তরে ডায়ানা কেবল বলেছিলেন, ‘আই ওয়ান্ট মাই হাজবেন্ড (আমার স্বামীকে চাই)।’
‘দ্য ডাচেস: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ বইতে পেনি জুনর বলেছেন, চার্লসের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ডায়ানার কাছে কোনো দিন দুঃখ প্রকাশ করেননি ক্যামিলা। উল্টো নিজের চেয়ে ১৪ বছরের ছোট ডায়ানাকে প্রথমে বলেছেন, ‘আ মাউস (একটা ইঁদুর)’; যখন ডায়ানা আর চার্লসের বাগদান হলো। আর বিয়ের কয়েক বছর পর বলেছেন, ‘দ্য ম্যাড কাউ (পাগলা গরু)’। ক্যামিলা জনসম্মুখে এ–ও বলেছেন, ‘আমি সারা জীবন একজনকেই ভালোবেসেছি। আর ডায়ানার জীবনে ছিল অসংখ্য পুরুষ।’ এদিকে ডায়ানাকে প্রকাশ্যে কখনো ক্যামিলা সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করতে শোনা যায়নি। তবে ডায়ানার মৃত্যুর পর তাঁর বান্ধবী সিমোন সিমোন্স ‘ডায়ানা: দ্য লাস্ট ওয়ার্ড’ বইতে লিখেছেন, ডায়ানা নাকি ক্যামিলাকে ‘রটওয়েলার (বিশেষ একপ্রকার কুকুর)’।
তাড়াহুড়া করেননি, পরিস্থিতি ‘ঠান্ডা হতে’ সময় নিয়েছেন চার্লস
মিডিয়ার নানা কানাঘুষার মধ্যে ১৯৯৫ সালে অ্যান্ড্রু পার্কার বোলস ও ক্যামিলার বিচ্ছেদ হয়। পরের বছর বিচ্ছেদ হয় প্রিন্স চার্লস ও ডায়ানার। এর পরের বছর গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান ডায়ানা। ফলে প্রিন্স চার্লস আর ক্যামিলার মধ্যে আর কোনো বাধা ছিল না। তবু প্রিন্স চার্লস ‘সবকিছু ঠান্ডা’ হওয়ার জন্য সময় নিয়েছেন। ডায়ানার মৃত্যুর পরও চার্লস ও ক্যামিলা তাঁদের সম্পর্ক চেপেই রেখেছিলেন।
যদিও তাঁরা একসঙ্গে বসবাস শুরু করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে প্রথম তাঁরা হাতে হাত রেখে জনসম্মুখে আসেন। এরও ছয় বছর পর ২০০৫ সালে বিয়ে করেন এই জুটি। সেই বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন রানি এলিজাবেথ। যদিও বিয়ের পর একাধিক গণমাধ্যমের শিরোনাম ছিল এ রকম, ‘আ রয়্যাল কাপল, পিপল কুড নেভার লাভ (এক রাজকীয় দম্পতি, জনগণ যাঁদের কখনোই ভালোবাসতে পারবে না)।’
এলিজাবেথই বছরের শুরুতে ঘোষণা দেন, তাঁর মৃত্যুর পর ব্রিটিশ রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী হবেন প্রিন্স চার্লস। ক্যামিলার উপাধি নিয়ে অনেক কানাঘুষা ছিল। কেননা রাজপরিবারের নিয়ম অনুযায়ী বিচ্ছেদ হয়েছে, এমন কেউ রানি হতে পারবেন না। এলিজাবেথই ক্যামিলার উপাধি ঠিক করে দেন ‘কুইন কনসর্ট’ (পুরোপুরি রানি নন, কেবল রাজার জীবনসঙ্গী)।
যখন চার্লস আর ডায়ানার সম্পর্কের ক্রমেই অবনতি হচ্ছিল, রানি এলিজাবেথ সে সময় দুজনকেই আলাদা করে ডেকে শেষবারের মতো চেষ্টা করতে বলেছিলেন। কেননা সেই বিয়ে থেকে রানির অনেক আশা ছিল। রানি জানতেন, এই বিচ্ছেদ রাজপরিবারের জন্য ভয়াবহ হুমকি ডেকে আনবে। ডায়ানার অনুরাগীরা রাজপরিবারের প্রতি আস্থা হারাবে। কেবল ডায়ানার অনুপস্থিতিই রাজপরিবারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট।
এ ছাড়া তিনি তাঁর দুই নাতি প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারির বড় হয়ে ওঠায় মা–বাবা উভয়ের অংশগ্রহণ চাচ্ছিলেন। যদিও ডায়ানার ওই সাক্ষাৎকারের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। রানি জানতেন, পরিস্থিতির জন্য তাঁর পুত্রের দায়ই সিংহভাগ। কিন্তু রাজপরিবারের ছেলের পরকীয়ার বিষয়টি মিডিয়ার সামনে আসুক, বিশ্বের মানুষ জানুক—ডায়ানার এই ‘অপরাধ’ তিনি ক্ষমা করেননি। এদিকে বড় ছেলেকে রাজা বানানোর জন্য তিনি আইন বদলেছেন। ক্যামিলাকেও মৃত্যুর আগে তাঁর ‘যথাযোগ্য’ সম্মান ‘কুইন কনসর্ট’ দিয়ে গেছেন। এ যেন ক্যামিলার ধৈর্য আর ভালোবাসার জন্য বিয়ের আগে তিন যুগ আর বিয়ের পর দেড় যুগের নীরব যুদ্ধজয়ের উপহার।