স্বামী–স্ত্রী দুজনই চাকরি করছেন— দুজনেরই দশটা–পাঁচটা অফিস। এই সময়টুকুর বাইরে বাকি সময়ে কে কী করেন? আপনি স্বামী হয়ে থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উত্তরটা খুব একটা সুখকর হবে না। কারণ, সামাজিকভাবেই কিছু বিষয় আমরা নারী-পুরুষের জন্য আলাদা করে রেখেছি। আর তাই অফিসের বাইরেও পরিবারের অনেক বিষয় নারীকে এখনো একা হাতে সামলাতে হয়। দুজনে একসঙ্গে অফিস থেকে ফিরলেও অনেক স্বামীই আশা করেন, তাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেবেন স্ত্রী। সন্ধ্যায় হালকাপাতলা নাশতা বানিয়ে দেবেন, আর টিভি দেখতে দেখতে সেই নাশতা স্বামী খাবেন সোফায় গা এলিয়ে। মোটা দাগে এখনো এটাই বাংলার চিত্র।
সব ক্ষেত্রে বিষয়টি হয়তো এমন নয়, অবস্থার বদল ঘটছে—এটাই আশার খবর।
স্ত্রীর পাশাপাশি স্বামীরাও যদি রান্না, ঘর পরিষ্কার, কাপড় ধোয়া, সন্তান পালনের মতো কাজগুলো ভাগ করে নেন, তাহলে পরিবারের চেহারাটা হতে পারে ভিন্ন রকম। অনেক পুরুষ এখন কাজের ভেদাভেদ ভেঙে এগিয়ে আসছেন ঘরের কাজে, তবে সেটা সংখ্যায় খুব বেশি না। আবার অনেকে ইচ্ছা থাকলেও ‘বাকিরা কী ভাববে’ মনে করে পিছিয়ে যান। এই এক পা এগিয়ে এসে দুই পা পিছিয়ে যাওয়া স্বামীরা চাইলেই সাহস নিয়ে শুরু করতে পারেন। আর এই কাজে স্বামীকে পদক্ষেপ নিতে হবে নিজ ইচ্ছায়, ভালোবেসে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা মোস্তফা খানম বলেন, ‘কর্মজীবী স্ত্রীর পাশে থাকতে হবে সহমর্মিতা নিয়ে। আর এই ইচ্ছে বা আগ্রহটা স্বামীর নিজ থেকে আসতে হবে। স্ত্রী বলে বলে এই গুণটা স্বামীর মধ্যে আনতে পারবেন না, যতক্ষণ না স্বামী নিজে অনুভব করছেন। পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যরাও উৎসাহ দিয়ে স্বামীকে ঘরের কাজে যুক্ত করতে পারেন।’
পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য মানে মা–বাবা, বড় ভাই–বোন, দাদা-দাদির মতো মুরুব্বি। তারা নিজেরা হয়তো পারিপার্শ্বিক চাপে কাজটা করতে পারেননি, কিন্তু সন্তানকে সেদিকে উৎসাহ দিলে কাজ হবে।
দীর্ঘদিন ধরে আমাদের পরিবার, সমাজ, শিক্ষার মতো জায়গায় ছোটবেলা থেকে নারীর কাজ আর পুরুষের কাজের ধরন আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। নারীর কাজ মানে রান্নাবান্না, সেলাই, ঘরদোর সামলানোর মতো বিষয়গুলোই উদাহরণ হিসেবে সামনে এসেছে। আর পুরুষের বেলা দেখানো হত হাটে, মাঠে, অফিস–আদালতের কাজ। একটা শিশু যখন ছোটবেলা থেকে এমন বিষয় দেখে বড় হবে, স্বাভাবিকভাবেই এটা তার মধ্যে সারা জীবনের মতো গেঁথে যাবে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
আর তাই বাইরের কাজের ক্ষেত্রে এখন যেহেতু নারী-পুরুষের ভেদ নেই, ঘরের কাজেও সেটা থাকা অনুচিত।
স্বামীর করণীয়
স্ত্রীর পাশে থাকতে চাইলে স্বামীকে ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে। আর এই কাজ ভাগাভাগির বিষয়গুলো মেনে চললে নিজেদের মধ্যেও কোয়ালিটি টাইম কাটানোর সুযোগ মিলবে। তাই স্ত্রীর সঙ্গে মিলে স্বামীরা যা করতে পারেন—
স্ত্রীর সঙ্গে ঘরের কাজ শুরুর আগে ‘লোকে কী বলবে’ টাইপ যে চিন্তা আপনার মধ্যে এসেছে, সেটা কাটাতে পারেন ব্যাচেলর থাকা অবস্থায় মায়ের কাজে সাহায্য করে। বিয়ের আগে থেকে টুকটাক ঘর পরিষ্কার রাখা, নিজের কাপড় নিজে কেচে নেওয়া, ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখা, খাবার টেবিলে বসার আগে থালাবাটিগুলো টেবিলে আনা, খাওয়ার পর নিজের প্লেট ধুয়ে রাখার মতো বিষয়গুলোর চর্চা শুরু করতে পারেন। এতে বিয়ের পরও কাজগুলো চালিয়ে গেলে লোকে কী ভাববে–জাতীয় ভাবনা নিজের মধ্যে আসবে না।
বিয়ের পর স্ত্রী যেহেতু অফিসে যাবে, একই সময়ে দুজনে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করুন। স্ত্রী যদি নাশতার জন্য সবজি কুটতে বসে, আপনি রুটি সেঁকার দায়িত্ব নিন কিংবা উল্টোটাও হতে পারে। এতে দুজন মিলে গল্প করতে করতে দ্রুত রান্নার কাজ শেষ হয়ে যাবে।
খাওয়ার পরে স্ত্রী অফিসের জন্য তৈরি হতে গেলে আপনি থালাবাটিগুলো ধুয়ে গুছিয়ে রাখতে পারেন।
‘আমি রান্না করতে পারি না’ বলার মধ্যে বিশেষ কোনো বাহাদুরি নেই। তাই প্রয়োজনে শিখে নিন। এক বেলা স্ত্রী রান্না করলে আরেক বেলা নিজে রান্নার চেষ্টা করুন। শুরুতে অনেক নারীও রান্না পারেন না, তবে নিজের আগ্রহ থেকে শিখে নিন। আপনিও সেটাই করুন। আর আজকাল ইউটিউবের মতো শিক্ষক থাকতে রান্না শেখা কোনো ব্যাপারই না।
অফিস থেকে ফিরে আপনি হয়তো বাজারটা সেরে নিলেন, স্ত্রী এই সময়ে বাকি কিছু কাজ গুছিয়ে নিতে পারবেন।
সন্তানকে রোজ রোজ স্কুল থেকে শুধু মা–ই নিয়ে আসবে কেন? সপ্তাহের পাঁচ দিন নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিন। কখনো স্ত্রী গেলেন, কখনো আপনি। এতে সন্তানদেরও ভালো লাগবে। আবার সন্তানের বন্ধুবান্ধব, তাঁদের অভিভাবকদের সঙ্গেও কুশলাদি বিনিময় হবে।
স্ত্রী হয়তো এক সপ্তাহ অফিসের কাজের চাপে আছে, সেই সপ্তাহ তাকে বাকি ঝামেলাগুলো থেকে ছুটি দিন। কোন বেলা খাবারের মেন্যু কী হবে, বাবা-মায়ের খোঁজখবর, সন্তানের স্কুল ও পড়াশোনার দিকটা নিজে সামলে নিন। এতে স্ত্রী অফিসের কাজেও কিছুটা কম চাপ বোধ করবেন।
হয়তো অফিস শেষে রাতে কোনো দাওয়াত আছে। স্ত্রী বাড়ির সব কাজ সামলে আবার নিজেকে তৈরি করে বের হতে গেলে একটু সময় বেশি লাগবেই। তাই স্ত্রীর কাছ থেকে এই সময়ে আপনি ছোট কাজগুলো বুঝে নিয়ে নিজেই করে ফেলুন। এতে নিজেদের সময় বাঁচবে।
অফিসে কাজের ফাঁকে একটা সময় বিরতি নিন। এই সময়ে স্ত্রীকে ফোন করুন। তার খোঁজখবর নিন। বিশেষ করে দুপুরের খাবার খেয়েছেন কি না, শরীর ভালো কি না—এসব বিষয় খেয়াল রাখুন।
বাসায় সব ধরনের কাজ শেষে স্ত্রী যাতে একটা একান্ত সময় (মি টাইম) কাটাতে পারেন, সেটা আপনিই নিশ্চিত করতে পারেন। হয়তো এই সময়ে স্ত্রী তাঁর পছন্দের একটা বই নিয়ে বসেছে, আপনি এক কাপ চা বানিয়ে দিন।
পরিবারের বাকি সদস্যরা হয়তো অনেক কিছু বুঝবেন না। চট করে স্ত্রীর হয়ে নিজেই সেই বিষয়গুলো সমাধানের চেষ্টা করুন।
সমাজবিজ্ঞানী সুলতানা মোস্তফা খানম মনে করেন, একজন নারী যখন পরিবার থেকে যথাযথ সহযোগিতা পাবেন, নিজের কর্মক্ষেত্রেও তিনি সাফল্য দেখাতে পারবেন। আর স্ত্রী সব চাপ একা নিতে গেলে একটা সময় দাম্পত্য সম্পর্কেও তার প্রভাব পড়বে। পরিবারে তৈরি হবে অশান্তি। তাই স্বামী হিসেবে স্ত্রীর পাশে থাকতে পুরুষদের উৎসাহ দিতে পারে তাঁর পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক মনোভাব, সঠিক শিক্ষার মতো বিষয়।
এখন তো বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি ছেলেমেয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। কোনো দিন জগের পানি গ্লাসে ঢেলে না খাওয়া ছেলেটাকেও বিদেশে গিয়ে নিজের সব কাজ নিজেকে করতে হচ্ছে। রান্না করা থেকে ঘর ঝাড়ু—বিদেশে যদি এসব করতে পারেন, দেশে নয় কেন! মূলত সামাজিক বাধার কারণে এ দেশে পুরুষেরা অনেক সময় ঘরের কাজ করাটাকে মেয়েলি কাজ হিসেবে দেখেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাইরের জগৎ সম্বন্ধে যতই মানুষের চেনাজানা বাড়ছে, ততই কমছে এমন ধারণাগুলো।