বিচ্ছেদের পরও সহজ সম্পর্ক কেন জরুরি

‘আমার যখন দেড় বছর বয়স, তখন আব্বু-আম্মুর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মা আর নানির কাছেই বড় হওয়া। ৩০ বছরে বাবার সঙ্গে তিনবার দেখা হয়েছে কি না সন্দেহ। দুই বছর হলো আমার বাবা মারা গেছে। খবর শুনেছি আরকি। ফলে আমার সবকিছুই মায়ের দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা। কখনো বাবার অভাব বোধও হয়নি বিশেষ। আমি দিব্যি ভালো আছি। মাকে ভীষণ ভুগতে দেখেছি। কোনো পুরুষের আমার প্রয়োজন নেই। আসলে সেভাবে অভাব বোধ হয় না। বন্ধুরা আছে। আমি আর মা মিলে খারাপ নেই তো।’


কুষ্টিয়া থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষে রাজধানীর একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে ঘরে থেকেই সিঙ্গাপুরের একটা কোম্পানিতে চাকরি করছেন চড়ুই (ছদ্মনাম)। নানি মারা গেছে তা–ও আট বছর হতে চলল। কিছুদিনের ভেতর অবসর নেবেন তার সেবিকা (নার্স) মা। তারপর মাকে নিয়ে উড়াল দেবেন সিঙ্গাপুর। বিয়ে করার কোনো পরিকল্পনা নেই বলেই জানালেন ৩২ বছরের চড়ুই।

অনেকেই আমাকে নিয়ে মজা করেছে, হেয় করে কথা বলেছে। আমার মাকে নিয়ে বাজে কথা বলেছে। অতিরিক্ত সহানুভূতি দেখানো, ফাদার ফিগার হয়ে সুযোগ নিতে চাওয়া—এগুলো তো ছিলই। এগুলো এখন কিচ্ছু গায়ে লাগে না। এগুলোকে সঙ্গী করেই আমরা ভালো থাকা শিখে গেছি।

দুজন মানুষের বিচ্ছেদ হতেই পারে, সম্পর্কে ঘটতে পারে ছন্দপতন। কিন্তু সেই তিক্ততা যদি সন্তানকেও স্পর্শ করে! চড়ুই বলেন, ‘এই সমাজে মেয়ে হয়ে জন্মানো আর বাবা না থাকা একটা অপরাধ। ছোটবেলা থেকেই আমি টিজিংয়ের শিকার হয়েছি। অনেকেই আমাকে নিয়ে মজা করেছে, হেয় করে কথা বলেছে। আমার মাকে নিয়ে বাজে কথা বলেছে। অতিরিক্ত সহানুভূতি দেখানো, ফাদার ফিগার হয়ে সুযোগ নিতে চাওয়া—এগুলো তো ছিলই। এগুলো এখন কিচ্ছু গায়ে লাগে না। এগুলোকে সঙ্গী করেই আমরা ভালো থাকা শিখে গেছি।’

দুজন মানুষের বিচ্ছেদ হতেই পারে, সম্পর্কে ঘটতে পারে ছন্দপতন

চড়ুই আর তাঁর মায়ের চলার পথটা আরেকটু সহজ হতেই পারত। কিন্তু আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি বিচ্ছেদেরই পরবর্তী চিত্র নেতিবাচক। বিচ্ছেদ মানেই যেন মুখ–দেখাদেখি বন্ধ, সুযোগ পেলেই একে অন্যকে আক্রমণাত্মক কথা বলা, অসম্মান আর ছোট করা। আর সঙ্গে যদি তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে সংসারে ‘সন্তান’ থাকে, তবে অনেক ক্ষেত্রে সেই সন্তানকে নিয়ে চলে অঘোষিত যুদ্ধ! কিন্তু এই বিচ্ছেদ কি আরেকটু কম যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে না? হাসিমুখে না হোক, অন্তত কোনো কাদা–ছোড়াছুড়ি না করে কি দুজন দুপথে নতুন যাত্রা শুরু করতে পারে না? ন্যূনতম বন্ধুসুলভ সম্পর্ক রাখাটা কি অনেক কঠিন? অন্তত সন্তানের দিকে চেয়ে।  

বিচ্ছেদ অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক একটা প্রক্রিয়া। এই সময় পরিবেশ যতটা সহজ, স্বাভাবিক রাখা যায়, ততই ভালো। বিচ্ছেদের পর ন্যূনতম সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা কেন জরুরি?  

বিচ্ছিন্ন  মা–বাবার মধ্যে দ্বন্দ্ব মা, বাবা ও সন্তান—তিন পক্ষেরই মানসিক চাপ বাড়ায়। সন্তানের ভেতর হীনম্মন্যতা তৈরি করে। এসব সন্তানের মধ্যে পরে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা যায়।
বিচ্ছিন্ন মা–বাবার মধ্যে দ্বন্দ্ব মা, বাবা ও সন্তান—তিন পক্ষেরই মানসিক চাপ বাড়ায়

মনের ওপর চাপ কমান


বিচ্ছেদের পরও বন্ধুসুলভ সম্পর্ক উভয়েরই মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে। উভয় পক্ষের জন্যই ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করে। জার্নাল অব ম্যারেজ অ্যান্ড ফ্যামিলিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিচ্ছিন্ন  মা–বাবার মধ্যে দ্বন্দ্ব মা, বাবা ও সন্তান—তিন পক্ষেরই মানসিক চাপ বাড়ায়। সন্তানের ভেতর হীনম্মন্যতা তৈরি করে। এসব সন্তানের মধ্যে পরে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা যায়। অন্যদিকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাপের মাত্রা কমায়, মানসিকভাবে ভালো থাকতে সাহায্য করে। সবাই নিজেদের জীবনে সহজভাবে সামনে এগিয়ে যেতে পারে।

বিচ্ছেদের পরও দুজনে মিলে সন্তান পালন


বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে কো–প্যারেন্টিং। এখন প্রায়ই দেখা যায়, আলাদা হয়ে যাওয়ার পরও দুজনে মিলে সন্তানকে নিয়ে খেতে যাচ্ছেন, বেড়াতে যাচ্ছেন বা নিদেন ছুটির দিনটা বাবার সঙ্গে কাটাচ্ছে সন্তান। ওই মানুষটাকে আপনার হয়তো আর প্রয়োজন নেই, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনার সন্তানের আছে। একটি ভেঙে যাওয়া সম্পর্কে যদি সন্তানও জড়িত থাকে, তবে সেখানে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অনেক জরুরি। এই সম্পর্ক সন্তানকে স্থিতিশীল করে, বেড়ে ওঠার সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করে ও বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ায়। ২০১২ সালে জার্নাল অব ফ্যামিলি সাইকোলজিতে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, শিশুর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের জন্য বিবাহবিচ্ছেদের পর ইতিবাচক প্যারেন্টিংয়ের অনুশীলন জরুরি।

বিচ্ছেদ ছাড়া যদি কোনো পথ খোলা না-ই থাকে, সেটা হোক মসৃণ। দুজনেই পরিপক্বতা, ইতিবাচকতা আর উদারতার সঙ্গে সেটা সামাল দিন।

শিশুদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ভালো প্রভাব


২০০৭ সালে জার্নাল অব ফ্যামিলি সাইকোলজিতে প্রকাশিত সমীক্ষায় বিবাহবিচ্ছেদের পর ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলোয় শিশুর মানসিক বিকাশ নিয়ে গবেষণায় দেখা যায়, যে সন্তানেরা বাবা ও মা উভয়ের সংস্পর্শে বড় হয়েছেন, তাঁরা পরবর্তী সময়ে একাডেমিক আর পেশাজীবনেও ভালো করেছেন।

সম্পর্কও ছন্দ হারায়, ফিকে হয়, আবার শীতের শেষে বসন্ত আসে, নতুন পাতা গজায়

ভালো স্মৃতি সংরক্ষণ


সময় সব সময় একই রকম থাকে না। সম্পর্কও ছন্দ হারায়, ফিকে হয়, আবার শীতের শেষে বসন্ত আসে, নতুন পাতা গজায়। তবে সম্পর্কে তিক্ততা আসার আগেই সঙ্গীর সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করুন। বিচ্ছেদ ছাড়া যদি কোনো পথ খোলা না-ই থাকে, সেটা হোক মসৃণ। বিচ্ছেদ পরিপক্বতা, ইতিবাচকতা আর উদারতার সঙ্গে সামাল দিন। সম্পর্কে ভালো দিন তো ছিলই, সেগুলোকে সঙ্গী করে রাখুন। খারাপ সময়গুলো শীতের পাতার মতো স্মৃতির অলিগলিতে ঝরে পড়তে দিন। প্রাক্তনকে শুভকামনা জানিয়ে নতুন শুরুর জন্য প্রস্তুত হোন। এগিয়ে যান।

তবে এত কিছুর পরও কথা থাকে। সব সময় সবার জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হয় না। হয় না। কেননা, এটাও সম্পর্কের মতোই একটা দ্বিপক্ষীয় ব্যাপার।

দুজনেই সম্মান নিয়ে এগিয়ে যান


অনেক সময় দেখা যায়, বিচ্ছেদ হওয়া দুজন মানুষ একই সামাজিক বলয়ের বা পেশার অন্তর্ভুক্ত। সামাজিক, পারিবারিক অনুষ্ঠান, আড্ডা, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে গিয়ে যদি মুখোমুখি হন, সেটা ভালোবাসাপূর্ণ যদি না-ও হয়, সম্মানের সঙ্গে তো হতেই পারে, তাই না? অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্ব এড়ান।


ন্যূনতম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে দুজনেই আন্তরিক হোন। একটি স্বাস্থ্যকর, ইতিবাচক পরিবেশ তৈরিতে, চাপমুক্ত জীবনে এগিয়ে থাকতে এটি আপনাদের সাহায্য করবে।

বিচ্ছেদ যন্ত্রণার, সেখানে জটিলতা যথাসম্ভব পরিহার করার ব্যাপারে দুই পক্ষকেই আন্তরিক হতে হবে

তবে এত কিছুর পরও কথা থাকে। সব সময় সবার জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হয় না। হয় না। কেননা, এটাও সম্পর্কের মতোই একটা দ্বিপক্ষীয় ব্যাপার। আপনি কেবল আপনার পক্ষ থেকে সম্মান দেখালে, বন্ধুত্বের হাত বাড়ালে তো হবে না। আর সব সময় পরিস্থিতি বন্ধুত্বপূর্ণও থাকে না। বিবাহিত জীবনের অধ্যায়গুলো যদি কেবল শারীরিক ও তীব্র মানসিক নির্যাতন, অত্যাচার, বঞ্চনার ইতিহাস হয়, সেখানে যোগাযোগ রাখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সন্তানের জন্যও যদি অপর পক্ষ ক্ষতিকর হয়, সন্তানকে নিজের কাছেই রাখুন। প্রয়োজনে আইনি সহায়তা নিন। সবার আগে নিজের ও সন্তানের সুরক্ষা ও মঙ্গল। প্রতিটি বিচ্ছেদের গল্পই আলাদা। তাই আপনিই ভালো জানেন, আপনার বা আপনাদের জন্য কোনটা সবচেয়ে ভালো।