২৫ বছরের যাত্রায় ‘নকশা’কে নানাভাবে পরামর্শ ও সহায়তা দিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় রূপবিশেষজ্ঞ, ডিজাইনার, অন্দরসজ্জাবিদ, মডেল, রন্ধনবিদেরা। রজতজয়ন্তীতে এমন পাঁচজন জানালেন ‘নকশা’র সঙ্গে কাজ করার অনুভূতি।
একদম শুরু থেকেই প্রথম আলোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক। খুব কাছ থেকে দেখেছি, পত্রিকাটি সব সময় সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়ে অসংখ্য পাঠকের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। এই দীর্ঘ পথচলায় শুধু ‘নকশা’ই নয়, বিভিন্ন সময়ে প্রথম আলোর বিভিন্ন সৌন্দর্য ও জীবনশৈলীবিষয়ক প্রকাশনা, ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার’, ‘নকশা বিয়ে উৎসব’সহ বিভিন্ন আয়োজনে একসঙ্গে কাজ করেছি। আর প্রায় প্রতি মাসেই বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ‘নকশা’র সঙ্গে কাজ করা হয়েছে। মৌসুম ধরে, উৎসবের সময়, কনে সাজে সব সময়ই চেষ্টা থাকত পাঠকদের সামনে নতুন কিছু উপস্থাপন করার। যেকোনো ফটোশুটের আগে সাজপোশাক নিয়ে দুই-তিন দিন ধরে ভাবা হয়েছে। এরপর সেটির ওপর কাজ করেছি। ঢাকার ভেতরে, ঢাকার বাইরে, পারসোনার কর্মীরা মডেলদের সাজিয়েছেন দিনের পর দিন। প্রথম আলোর সঙ্গে আমার এবং ‘পারসোনা’র সম্পর্ক অনেকটাই পারিবারিক। সাজের ক্ষেত্রে নতুন নতুন ধারা উপস্থাপন করেছে ‘নকশা’, সামনেও করবে, এমনটাই আশা থাকবে। আশা করি, এই সম্পর্ক অতীতের মতো আগামী দিনগুলোতেও একইভাবে অব্যাহত থাকবে।
১৯৯৮ সালে এল নতুন পত্রিকা প্রথম আলো। রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলা, বিনোদন, জীবনযাপন—সবকিছু নিয়ে ঝকঝকে একটি দৈনিক। অনেক কিছুই শুরু করছে প্রথম আলো। যেমন ‘নকশা’। দ্রুত পরিবর্তনশীল ফ্যাশন ও লাইফস্টাইলের খুঁটিনাটি নিয়ে সময়োপযোগী তথ্য থাকার জন্য গত ২৫ বছর ধরেই ‘নকশা’র ওপর নির্ভর করে আসছে পাঠক।
দেশীয় কারুশিল্পী, বয়নশিল্পী, ডিজাইনারদের নিয়ে আমাদের কাজকে নানাভাবে সমর্থন দিয়েছে ‘নকশা’। দেশের মানসম্পন্ন এবং সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে, ভালো কাজের অনুপ্রেরণা ও সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘নকশা’র আন্তরিকতার কমতি নেই। ‘নকশা’র একটি প্রতিবেদনে কোনো কোনো উদ্যোক্তার জীবন পাল্টে গেছে, উদ্যোগকে বিকশিত করেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক গুণী কারুশিল্পী, তাঁতি প্রথম আলো ও ‘নকশা’র মাধ্যমে আজ সারা দেশে পরিচিত। ভালো কাজের জন্য তাঁরা প্রশংসিত ও সম্মানিত।
অনেক অনেক ভালো কাজের মধ্যেও কিছু অপূর্ণতা রয়ে গেছে। দেশীয় ক্ষুদ্রশিল্পের সম্ভাবনার পাশাপাশি রয়েছে নানা সংকট ও চ্যালেঞ্জ। প্রত্যাশা করি, ভবিষ্যতে এসব বিষয় পাঠকের কাছে তুলে ধরবে ‘নকশা’।
‘নকশা’র রেসিপির জন্য এখন যেমন রান্না তৈরি করে রাখলে যথাসময়ে ফটোগ্রাফার এসে ছবি তুলে নিয়ে যান, শুরুর দিকে কিন্তু বিষয়টি এত সহজ ছিল না। আমাকে ছবি তুলে রেসিপির সঙ্গে পাঠাতে হতো। এসএলআর ক্যামেরা দিয়ে ওই সময় আমরা কাজ করেছি। নেগেটিভ দেখে পছন্দমতো ছবি প্রিন্ট করতে দিতাম। ছবি বেশির ভাগ সময় আমার স্বামী তুলে দিতেন। তিনি ব্যস্ত থাকলে আমি নিজেই তুলতাম। ক্যামেরায় ফিল্ম লোড করে দিতেন তিনি। একদিন ব্যস্ততার কারণে তিনি ছবি তুলতে পারবেন না, তাই আমি বললাম, অফিসে যাওয়ার আগে ক্যামেরায় ফিল্ম লোড করে দিয়ো। আমি রেসিপি তৈরি করে পরিবেশন পাত্রে সাজিয়ে ছবি তুললাম। ছেলে স্কুল থেকে বাসায় আসার পর তার হাতে ক্যামেরা দিয়ে ওয়াশ করে আনতে বললাম। কিছুক্ষণ পর ছেলে এসে বলল, ‘মা তুমি তো ক্যামেরায় ফিল্ম লোড করোনি।’ পরদিন সকালে ছবিসহ রেসিপি জমা দিতে হবে। বাসায় মেহমান আসায় রান্না করা রেসিপির কিছু খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলাম। আমার তো মাথায় হাত! রাতের ভেতর ছবি তুলতেই হবে। সেই রাতে আবার রান্না করে, ছবি তুলতে হলো।
আরেকবার প্রথম আলো থেকে ফোন করে বলা হলো, ‘আপা, গরমে কিছু আইসক্রিমের রেসিপি চাচ্ছি, আপনি পারবেন তো?’ মনে মনে ভাবলাম, আইসক্রিমের ছবি, এ আর এমন কী! পাঁচ–ছয় রকম আইসক্রিম বানালাম। সেদিন অনেকবার বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। বিদ্যুৎ আসার পর এসি অন করে ছবি তোলার কাজ শুরু করলাম। লেমন ললি ও কুলফি ছাড়া বাকি সব আইসক্রিম গলে গিয়েছিল। সব আইসক্রিম আবার জমাতে দিলাম। সে রাতে ঘুম আসেনি। সকালের ঠান্ডা আবহাওয়ায় এসি অন করে ঘরটা ভালোমতো ঠান্ডা করে তবে আইসক্রিমের ছবি তুলি। এ ধরনের অনেক টুকরো ঘটনা আজও মনে পড়ে।
আরেকবার চাওয়া হলো কচুরিপানা ফুলের কয়েকটা রেসিপি। চিন্তাভাবনা করে দেখলাম, রেসিপি নাহয় দিলাম, কিন্তু ছবি তোলার জন্য বাড়তি–সতেজ কচুরিপানা ফুল পাব কোথায়? নিউমার্কেট কাঁচা বাজার, হাতিরপুল বাজার, কাঁঠালবাগান বাজার, এমনকি কারওয়ান বাজার ঘুরে কোথাও কচুরিপানা ফুল পাওয়া গেল না। নিরুপায় হয়ে প্রথম আলোর আলোকচিত্রী খালেদ সরকারকে ফোন করে বললাম। ছবি তোলার দিন ঠিকই তিনি কচুরিপানার ফুল নিয়ে হাজির। প্রথম আলোর সঙ্গে ঘটে যাওয়া এ রকম বিভিন্ন ঘটনার কথা লিখে শেষ করতে পারব না।
২২ বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত আছি। পুরোটা সময়ই পাশে ছিল ‘নকশা’। যখন ‘ইউ গট দ্য লুক’ জিতেছিলাম, সেই ছবিও এসেছিল প্রথম আলোয়। সেখান থেকেই প্রথম আলোর সঙ্গে সম্পর্ক। ‘নকশা’র যাত্রাটাও আমি দেখেছি। যেভাবে ‘নকশা’ একটা সময়ে ছিল, সেখান থেকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে একটা জায়গায় নিয়ে এসেছে। ফ্যাশনের জায়গাটাও ‘নকশা’ খুব সুন্দর করে তুলে ধরে রেখেছে। ‘নকশা’র সঙ্গে অন্যভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতাও আমার আছে। শুধু মডেল হিসেবেই নয়, ‘নকশা’র মিলনমেলা আর ফ্যাশন শোর কোরিওগ্রাফিও করেছি। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছি। পুরো যাত্রাটাই ছিল আনন্দের। কোথায় যেন একটা ভালোবাসা আছে, ভালো লাগা আছে, আন্তরিকতা আছে। ‘নকশা’ এত দূর এসেছে, অভিনন্দন জানাই। ‘নকশা’ সব সময় দেশীয় ফ্যাশন, লাইফস্টাইল ইন্ডাস্ট্রির পাশে থাকবে, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে এবং নতুন প্রজন্মকে সে বিষয়ে উৎসাহিত করতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে ‘নকশা’। খুব ভালো লাগে যখন দেখি, অন্দরসজ্জাবিদ হিসেবে আমার লেখার মতো করে সাজানো হয়েছে কোনো গৃহকোণ। ‘নকশা’য় পাঠকদের জন্য অন্দরসজ্জা বিষয়ে লিখতে আমার ভালো লাগে। ‘নকশা’ সময় উপযোগী বিষয় নির্বাচন করে, লিখতে এ কারণেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। ‘নকশা’র সঙ্গে আছি এবং থাকব।