‘১৫ বছরের বিবাহিত জীবনে স্বামীর সঙ্গে থাকতে পেরেছি মাত্র ১৬ মাস’

মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন, সন্তান পালন বিষয়ে এই বিভাগে প্রশ্ন পাঠাতে পারেন। আজ নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম

পাঠকের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অধ্যাপক মেহতাব খানম
পাঠকের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অধ্যাপক মেহতাব খানম

প্রশ্ন: ২০ বছর বয়সে মা–বাবা আমার বিয়ে দেন। ছেলে ইতালিপ্রবাসী, ধনী পরিবার। ছেলের বয়স তখন ৩৬ বছর, আমি সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়েছি। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে ভালো মতো সম্পর্ক গড়ে ওঠার আগেই জানতে পারি, আমি অন্তঃসত্ত্বা। তারপর স্বামী আবার প্রবাসে চলে গেল, ফিরল পাঁচ বছর পর। চার মাস থেকে আবার চলে গেল। ছেলেকে নিয়ে আমি একাই থেকে যাই। স্বামীর সঙ্গে ফোনে কথা বলা ছাড়া আর কোনো বন্ডিং গড়ে ওঠার সুযোগ ছিল না। আমার কষ্টের সময়গুলো একাই কেটেছে।

আমাদের বিয়ের ১৫ বছর চলে এখন। সব মিলে স্বামীর সঙ্গে একত্রে থাকার সুযোগ হয়েছে ১৬ মাসের মতো। এটা কেমন সংসার, আমি বুঝতে পারি না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যাই দূরে কোথাও। আমি যে অন্য কাউকে ভালোবাসি, সেটাও না। তবে আমার কিছুই ভালো লাগে না। স্বামীর সঙ্গে বয়সের ফারাক আর কাছে না থাকার কারণে মনে হয়, ১৫ বছর ধরে বিয়ের পরও একা জীবন কাটাচ্ছি। পড়াশোনা শেষ করে সন্তানের কথা ভেবে কোনো চাকরির চেষ্টাও করিনি। তবে স্বামী যে আমার খোঁজ রাখে না, সেটা বলছি না। মাঝেমধ্যে ঝগড়াও হয়, আবার ঠিক হয়ে যায়। তবে দাম্পত্যটা ঠিক গড়ে উঠল না। মনটা এসব নিয়ে বিক্ষিপ্ত থাকে। আমার কী করা উচিত, একটু পরামর্শ চাই।

নাজমা (ছদ্মনাম), আজিমপুর, ঢাকা

উত্তর: এটি খুবই দুঃখজনক যে মাত্র ২০ বছর বয়সে আপনার মা–বাবা ইতালিপ্রবাসী এবং আপনার চেয়ে ১৬ বছরের বড় একটি মানুষের সঙ্গে আপনার বিয়ে দিয়ে দেন। তাঁরা ধনী পরিবার, সেই বিবেচনাটিই কি অগ্রাধিকার পেয়েছিল? বিয়ের আগে স্বামীর সঙ্গে কথা বলার কোনো সুযোগ কি আপনার হয়েছিল? আপনি কি জানতেন, বিয়ের পর একাকী আপনাকে দেশেই থাকতে হবে, বহুদিন পর পর তিনি দেশে আসবেন? মানুষটির সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠার আগেই তার দ্বারা অন্তঃসত্ত্বাও হয়ে গেলেন। আপনাদের শিশুসন্তানটির সঙ্গেও তার বাবার কোনো সম্পর্কই গড়ে তোলা সম্ভব হলো না। বাবা নামের মানুষটি আসলে কেমন, বা বাবার স্নেহের স্বাদই বা কেমন, জানার সুযোগও ছেলেটির হলো না। আপনারা দুজনেই তাঁর সঙ্গ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হলেন। দীর্ঘ ১৫ বছরে অধরা এই মানুষটির সঙ্গ আপনারা পেলেন মাত্র ১৬ মাস।

আমার তো মনে হচ্ছে, আপনার পরিবারের এভাবে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটির কারণে আপনি শুধু বঞ্চিতই হয়েছেন। আপনি এবং আপনার নিরীহ সন্তান, দুজনেরই পরিবারের স্বাভাবিক পরিবেশে পাওয়ার অধিকার থাকা সত্ত্বেও সেটি নিশ্চিত করতে কেউ কোনো ভূমিকা রাখলেন না। আপনার ছেলেটির এখন বয়ঃসন্ধিকাল চলছে। বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, এই বয়সের ছেলেমেয়েরা মা–বাবা দুজনের তত্ত্বাবধানে থেকেও খুব সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। বিশেষ করে ছেলেসন্তানের বেড়ে ওঠার সময় বাবার সান্নিধ্য পাওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাবা যেহেতু একই লিঙ্গের মানুষ, সন্তানটি তাঁকে অনুসরণ ও অনুকরণ করতে ভালোবাসে। বাবারা যদি তাঁদের ছেলে সন্তানদের ভালোভাবে যত্ন নেন, অর্থাৎ তার জন্য একটি আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন, তাকে সুন্দরভাবে সঠিক দিকনির্দেশনা দেন, তাহলে তার আত্মনির্ভরশীল ও দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

আর একটি বিষয়ও আমাকে বিস্মিত করেছে। এত বছর হয়ে গেল, স্বামী আপনাকে তাঁর কর্মস্থলে বসবাস করার জন্য নিয়ে গেলেন না কেন? তিনি তো ধনী পরিবারের সন্তান। তাঁর পক্ষে সন্তান আর তার মাকে নিয়ে যাওয়া তো অসম্ভব কিছু না। আপনারা কি ইতালিতে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ পাননি? সন্তানকে নিয়ে আপনি কেন কখনো যেতে পারলেন না বা তিনি সেই ব্যবস্থাটি করলেন না—আমার বোধগম্য হচ্ছে না। এই কঠিন কথাগুলো হয়তো অনধিকারচর্চা হচ্ছে এবং আপনার কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে, কিন্তু আমারও খুব আশ্চর্য লাগছে এবং কষ্ট হচ্ছে বলে এই কথাগুলো বলছি। আপনার স্বামী কী সেখানে একাই থাকেন, নাকি তার সঙ্গে পরিবারের অন্য কোনো সদস্যও থাকেন?

আপনি তো পড়ালেখা শেষ করেছেন। এখন কোনো বিষয়ে প্রফেশনাল প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছু কাজ শুরু করতে পারেন কি? যদি কোথাও খণ্ডকালীন কিছু কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারতেন, তাহলে মনটা হয়তো কিছুটা ভালো লাগত। আপনি যদি বিমর্ষ হয়ে পড়েন, তাহলে ছেলের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করে ফেলার শঙ্কা তৈরি হতে পারে। গবেষণায় পাওয়া গেছে, যেসব মায়েরা খণ্ডকালীন কাজ করেন, তাঁদের সন্তানেরা পরিবেশের সঙ্গে বেশি খাপ খাইয়ে চলতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানদের সারাক্ষণ তদারকি করার ফলে তারা বিরক্ত বোধ করে, কথা শুনতে চায় না। আপনার স্বামী দূরে থেকে তো অর্থনৈতিক সহায়তা ছাড়া আর তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। আপনি লিখেছেন, মাঝেমধ্যে ঝগড়া হয়ে যায়, সেটিই স্বাভাবিক। কারণ, একসঙ্গে না থাকায় পরস্পরের প্রতি বোঝাপড়া তৈরি হওয়ার জন্য যে সময়গুলো কাটানো প্রয়োজন ছিল, তা তো হয়নি।

আরও একটি পরিবার তৈরি করার জন্য মানুষ বিয়ে করে, যেখানে একটি পারিবারিক আবহ তৈরি করে অনাগত সন্তানদের নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে আনন্দ ও কষ্টের সময়গুলো তারা ভাগ করে নেবে। আপনি কী শ্বশুরবাড়িতে থাকেন, না নিজের বাবা–মায়ের সঙ্গে, লেখেননি। আপনার স্বামী এবার দেশে এলে তাঁকে নিয়ে আপনারা সবাই আলোচনায় বসুন, আপনাদের তিনজনের জীবন কি এভাবেই চলবে? আপনারা তিনজন মিলে নতুনভাবে একটি ভিন্ন ধারার জীবন শুরু করতে পারেন কি না, এ ব্যাপারে সিরিয়াস আলোচনা হওয়াটা জরুরি।

ঘোষণা

পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। ই–মেইল ঠিকানা: adhuna@prothomalo.com (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ডাক ঠিকানা: প্র অধুনা, প্রথম আলো, ১৯ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA