জায়ের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন? ঢাকায় থাকেন এমন পাঁচজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। পুরান ঢাকা হয়ে ধানমন্ডি, মগবাজার হয়ে গুলশান, সবশেষে উত্তরা। তাঁদের ঠিকানা যেমন আলাদা, অর্থনৈতিকভাবেও পাঁচজনের অবস্থান ভিন্ন। তাঁদের মধ্যে কেউ বড় জা, কেউ ছোট জা। দুজনের উত্তর নেতিবাচক না হলেও পুরোপুরি ইতিবাচকও ছিল না, বললেন মাঝেমধ্যে হালকা ভুল–বোঝাবুঝি হয়েই যায়। বাকি তিনজন জানালেন, জায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো নয়। নাটক–সিনেমার মতো চুলোচুলি না হলেও মনোমালিন্য চলতেই থাকে।
এই বৈরী সম্পর্কের অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্য, জানালেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা মোসতাফা খানম। বিষয়টি আরও বিশদ করে এই সমাজবিজ্ঞানী বলেন, ‘দুই বউয়ের একজন হয়তো ভালো চাকরি করছেন, আরেকজন গৃহবধূ। যিনি চাকরি করেন, নিজেকে তিনি আরেকজনের চেয়ে উঁচু মনে করেন। পরিবারের বাকিরাও তাঁকে মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। এটা না করাই ভালো। এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন শ্বশুরবাড়ির মানুষজন। তাঁরা যেন দুই বউয়ের মধ্যে বৈষম্য প্রকাশ না করেন। দুজনের কাজকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। সন্তানকে ঠিকঠাক বড় করা এবং পরিবারকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চাকরির মধ্যে একটি। পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনকে যে বেশি সময় দিচ্ছেন, সকালে জেগে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমানোর আগপর্যন্ত বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছেন, সেও যেন পরিবারে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখিত হয়।’
বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে আরও একটি বিষয়ও সামনে এল, সেটা বাপের বাড়ির দাপট। অবস্থাপন্ন পরিবার মেয়ের বিয়ের সময় নানা রকম দরকারি–অদরকারি জিনিসপত্র দিয়ে থাকে। দুজন বউ বাড়িতে এলে কার বাপের বাড়ি থেকে কী দেওয়া হয়েছিল, সেই আলোচনা বিভিন্ন সময়ে সামনে আসে। এতে করে যিনি অপেক্ষাকৃত কম অবস্থাসম্পন্ন ঘরের মেয়ে, তিনি মন খারাপ করতে পারেন। এই মন খারাপ জমতে জমতে ক্ষোভে রূপ নেয়। মূল সমস্যা হয়, যখন দেখা যায়, টাকার ওপর ভিত্তি করে একজনকে বেশি মূল্যায়ন করা হচ্ছে, আরেকজনকে কম। ফলাফল, দুঃখ আর ক্ষোভ নেতিবাচক আচরণ হয়ে বেরিয়ে আসে।
দুই বা তিন জায়ের মধ্যে সম্পর্ক যে প্রথম দিন থেকেই নষ্ট হয়, বিষয়টি কিন্তু সে রকম নয়। দিনের পর দিন কিছু কিছু কারণ দুজনের মধ্যে তিক্ততা নিয়ে আসে। এই বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে একটা সময় পর অনেকে আলাদাও হয়ে যান। খারাপ সম্পর্ক থেকে আলাদা থাকতে শুরু করার পেছনে যে বিষয়গুলো কাজ করে তার মধ্যে আছে—
১. প্রয়োজনের সময় পরিবারিক কাজে সহায়তা না করা। শুধু নিজের কাজটুকুই করা। এতে করে আরেকজনের ওপর ভারী কাজগুলো পড়ে যায়।
২. একজন আরেকজনকে সম্মান না দেখানো।
৩. অন্যের মতামতকে গুরুত্ব না দেওয়া।
৪. নিজের কর্মস্থল বিষয়ে অহংকার প্রকাশ করা।
৫. লোক দেখানো কাজ করা।
৬. বাড়িতে যেই বউ আগে আসেন, তিনি সেই পরিবারের কাজকর্মের একটা ধারা তৈরি করেন। নতুন বউ এসে কোনো সৌজন্যবোধ ছাড়াই সেই কাজের মধ্যে ঢুকতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। এতে দুই জায়ের মধ্যে ঠোকাঠুকি শুরু হতে পারে।
৭. অনেক সময় এক জা আরেক জায়ের সন্তানের ওপর বেশি অধিকার খাটিয়ে ফেলেন। এতে দুজনের মধ্যে তিক্ততা বাড়তে শুরু করে।
৮. কার কত গয়না আছে, কার পরিবারে কতজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, কে বেশি সুন্দর—এমন সব বিষয় নিয়েও অনেক সময় জায়েদের মধ্যে খারাপ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
সমাধান কী
আপাতদৃষ্টে কারণগুলো অনেক তুচ্ছ মনে হলেও এগুলোই অনেক সময় হীনম্মন্যতার সৃষ্টি করে। সামনাসামনি বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার পরামর্শ দিলেন অধ্যাপক সুলতানা মোসতাফা খানম। তবে যিনি আগে বিষয়গুলো তুলবেন, অপর পক্ষ সেগুলো বুঝতে চাইবেন কি না, সেটাও ভেবে দেখতে হবে। যে বিষয়টি প্রচ্ছন্নভাবে থাকে, সেটা সামনে চলে আসার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে। আবার সরাসরি আলোচনায় অনেক ভুল–বোঝাবুঝির অবসান হয়ে যায়। এটা পুরোপুরি নির্ভর করে পরিস্থিতি আর মানসিকতার ওপর।
করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেক পরিবারকে দীর্ঘ সময় বাড়ির ভেতর থাকতে হয়েছে। একসঙ্গে বেশি সময় থাকার কারণে অনেক পরিবারে জায়েদের সমস্যাগুলো ছোট থেকে বড় হয়ে উঠে। এমনও দেখা যায়, বড় জা দিনের পর দিন ঘর ঝাড়া–মোছা থেকে শুরু করে সব ভারী কাজ করেছেন। পাশাপাশি বাচ্চা সামলানো আর হোম অফিসের কাজও তাঁকে করতে হয়েছে। ছোট জা শুধু নিজের কাজটুকুই করেছেন দিনের পর দিন। নেতিবাচক আচরণ বড় জাও করতে পারেন। ছোট জা বয়স আর মর্যাদায় ছোট হওয়ার কারণে সব সহ্য করে গেছেন, এমনও ঘটনাও আছে অসংখ্য। শ্বশুরবাড়িতে পরে আসার কারণে বাড়ির ছোট বউ হয়তো কোনো শব্দ ছাড়াই কাজ করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। তারপরও ছোট কোনো ভুল হলেও কথা শোনাতে ছাড়েন না বড় বউ। এমন আচরণে দুজনের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠা কঠিন।
সুলতানা মোসতাফা খানম বলেন, ‘একজনের সন্তানের ওপর আরেকজন বেশি আদিখ্যেতা না দেখানোই ভালো। “তোমার মায়ের চেয়ে আমি তোমাকে বেশি সময় দিচ্ছি, তোমার যত্ন নিচ্ছি”—শিশুর সঙ্গে এমন ভাব প্রকাশ না করাই ভালো। সম্পর্কের মধ্যে যে সীমারেখা থাকা জরুরি, সেটা অতিক্রম না করাই ভালো। জায়ের সন্তানকে ইতিবাচকভাবে দেখভাল করাই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে তাঁর মাকে জিজ্ঞেস করে নেওয়াই ভালো। এই জিজ্ঞেস করার কারণেই হয়তো মা খুশি থাকবেন।’
দুই জায়ের মধ্যে খারাপ সম্পর্ক গড়ে ওঠার আরেকটি কারণ উপেক্ষার মনোভাব। এই মানসিকতা বদলাতে হবে। ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। শ্বশুরবাড়ির অন্য মানুষেরা যখন পরিস্থিতি খারাপ দেখেও চুপ করে থাকেন, সংসারে অশান্তি তৈরি হয় তখনই। দুই জা নিজেরা যদি মিটমাট না করতে পারেন, তাহলে অন্যদের মাঠে নেমে পড়তে হবে। ছোট জা বা বড় জা, সমস্যার উৎপত্তি যাঁর কাছ থেকেই হোক, তাঁকে বোঝাতে হবে। জায়েরাও যদি এমন ভাব করে যে আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে কেউ নাক গলানোর দরকার নেই, তাহলে সমাধান হবে না। কারণ, আপনার ব্যক্তিগত আচরণ ততক্ষণে হয়তো অন্যদের প্রভাবিত ও আহত করছে।
যেসব পরিবারে শ্বশুর-শাশুড়ি নেই, সেখানে বড় ভাইকে গুরুজন হিসেবে রেফারির ভূমিকা নিতে হবে। ছোট বউ এবং দেবর যদি বড় ভাবিকে সম্মান না করেন, তাহলে বাড়ির গুরুজন হিসেবে বড় ভাইকে মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে। একইভাবে নিজের স্ত্রী যদি কোনো অন্যায় করে থাকেন, তাহলে সেটাও চেপে না গিয়ে তাঁকে বলতে হবে। সুলতানা মোসতাফা খানম বলেন, একসঙ্গে থাকার কারণে অনেক ঝামেলার সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আলাদা হওয়ার পর একসঙ্গে থাকার সুবিধাগুলো বোঝা যায়। ছোট জা কিছু বললে সঙ্গে সঙ্গে বড় জায়ের সেটা নিয়ে নেতিবাচকভাবে উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। একইভাবে ছোট জাকে বুঝতে হবে, এত দিন বড় জা পরিবারকে একভাবে সামলেছেন, বাড়ির সেই নিয়মটাকে না ভেঙে আগে সেটা বুঝতে হবে, এরপর নিজের মতামত জানাতে হবে।
চাইলেই দুই জায়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব। খারাপ লাগার বিষয়গুলো ভাগাভাগি করে নিন। এক বাড়িতে থাকা হোক বা না হোক, দুজনের সম্পর্কে যেন কোনো ভণিতা না থাকে। মনে রাখবেন, আপনারা দুজনই সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবেশে এসে পড়া দুজন মানুষ, কেউ হয়তো একটু আগে এসেছেন আর কেউ পরে, এই যা পার্থক্য। নতুন এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে এক জা–ই হতে পারেন আরেক জায়ের সবচেয়ে বড় সহায়ক।