আদবকেতায় ফরাসি শিশুদের তুলনা হয় না। এর পেছনে তাদের অভিভাবকদের অবদানই বেশি। কারণ, পরিবার হলো সামাজিকীকরণের প্রথম ধাপ। শিশুরা ভুল করে ফেললে ফরাসি মা-বাবারা সহজে শাস্তি দেন না। বরং পরবর্তী সময়ে স্নেহপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে ভুল ধরিয়ে দেন। এ ছাড়া এমন আরও কিছু কারণে ফরাসি শিশুরা আদবকেতায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকে। জেনে নিন সেসব, চাইলে নিজেরাও অনুসরণ করতে পারেন।
শিশুরা সাধারণত কোনো কিছু নিজে থেকে করতে গিয়ে বেশি শেখে। তবে অনেক অভিভাবকই তাঁদের শিশুসন্তানকে কোনো কাজই করতে দেন না। এদিক থেকে ফরাসি মা-বাবারা অনুকরণীয়। তাঁরা মনে করেন, পূর্ণবয়সী মানুষের মতো শিশুরাও চাইলে নিজের সব কাজ নিজেরাই গুছিয়ে করতে পারে। তাই তাঁরা শিশুদের নিজের কাজ নিজে করতে যথেষ্ট উৎসাহ জোগান। নিজের কাজ নিজে করতে পারলে শিশু শুধু সেই কাজই শেখে না, সঙ্গে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসী।
আমাদের অধিকাংশেরই ধারণা, ছোট ছোট যেকোনো কাজে শিশুদের সব সময় তুমুল প্রশংসা করা উচিত। শিশু ভালো কোনো কাজ করলে, কখনো কখনো দুষ্টুমি করলেও আমরা কেউ কেউ প্রশংসায় ভাসিয়ে দিই। সব কাজে প্রশংসা না করলে শিশু কষ্ট পেতে পারে বা শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, এমন ধারণাও পোষণ করেন কেউ কেউ। ফরাসি মা-বাবারা এদিক থেকে বেশ হিসাবি। তাঁরা সহজে শিশুদের প্রশংসা করেন না। শিশু খুব মুগ্ধ হওয়ার মতো কিছু করলে তাঁরা বরং প্রশংসার পক্ষপাতী। তাঁদের যুক্তি হলো, কথায় কথায় প্রশংসা শেষমেশ উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর মতো। ফরাসিরা শিশুর মুখে প্রথম বুলি শুনলেও আহ্লাদে গলে যান না। বরং শিশু যখন দারুণ কিছু বলে বা ভালোভাবে কথা বলে, তখনই প্রশংসা করেন। ফরাসি মা–বাবারা বিশ্বাস করেন, শিশু যখন সত্যিই প্রশংসনীয় কাজ করে, ঠিক তখনই বাহ্বা পেলে তা অর্থবহ হয়ে ওঠে।
ফরাসিদের বিশ্বাস, শিশু শিশুই। অর্থাৎ শিশুদের জীবনযাপন হতে হবে শিশুর মতোই। এ কারণে ফরাসি মা–বাবারা সব সময় শিশুদের সঙ্গে রাখেন না। তাঁদের মতে, শিশুকে সব সময় চোখে চোখে রেখে আদরযত্ন করার ধারণাটি ডাহা ভুল। শিশুকে তাঁরা নিজের মতো থাকতে দেওয়ার মতো সময় দেন। পেশাগত জীবনে ব্যস্ততার মধ্যে সন্তানের দেখভালে সময় ব্যয় করার ধারণায়ও তাঁদের প্রবল আপত্তি। অবশ্য ফরাসি মা–বাবারা যে সন্তানকে একেবারেই সময় দেন না, এমনটা ভেবে বসবেন না যেন। সন্তানদের জন্য তাঁরা যতক্ষণ সময় কাটান, সেটা বরাবরই হয় অর্থবহ। ফলে ফরাসি শিশুরা যেকোনো কিছুতে মা-বাবার ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে বসে থাকে না।
ফ্রান্সে ক্লান্ত–বিধ্বস্ত নতুন মায়েদের দেখা পাওয়া ভার। তার মানে কি ফরাসি নবজাতকেরা পৃথিবীতে এসেই ঠিক সময়ে ঘুমিয়ে পড়তে শিখে যায়? না, তা নয়। বরং ফরাসি মা–বাবারা একেবারে শুরু থেকেই শিশুদের রাতে ঠিকমতো ঘুমানোয় অভ্যস্ত করেন। অনেক শিশুই ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ জেগে থাকে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এমনটা চলে চক্রাকারে। শিশুর এই ঘুম ও জাগরণের মাঝখানে ফরাসি মা–বাবারা শশব্যস্ত হয়ে পড়েন না। দুলুনি দেওয়া, কিছু খাওয়ানো কিংবা পিঠ চাপড়ে দেওয়ার মতো কোনো কিছুই তাঁরা করতে যান না। তার বদলে শিশুকে কিছুটা সময় দেন আবার ঘুমিয়ে পড়ার জন্য। এতে শিশুর ঘুমটা হয় ভালো। আর এতেই শিশু অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
ফরাসি মা–বাবারা বাড়িতে শিশুদের জন্য আলাদা রান্নার আয়োজন করেন না। একজন পূর্ণবয়সী ফরাসি যেসব শাকসবজি বা ফল খান, শিশুরাও ঠিক একই খাবার খায়। এমনকি একেবারে নবজাতক শিশুর জন্যও আলাদা খাবার রান্না করার প্রচলন ফরাসিদের মধ্যে খুব একটা নেই। বাড়ির বড়দের জন্যে রান্না করা শাকসবজি বা ফল কিছুটা তরল করে নবজাতককে খাওয়ানো হয়। ছোট থেকেই বড়দের সঙ্গে একই খাবার খাওয়ার অভ্যাস ফরাসি শিশুদের ‘টেস্ট বাড’কে আরও পোক্ত করে। ফলে স্বাস্থ্যকর খাবারে অভ্যস্ত হওয়া তাদের জন্য খুব স্বাভাবিক। এ কারণে ফরাসি শিশুরা খাবারের বেলায় ‘এটা খাব না, ওটা খাব না’ করে না।
ফরাসি মা–বাবাদের বিশ্বাস, কিছু শেখার বেলায় বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা দারুণ কেজো। জীবনের এই বাস্তবতা থেকে শিশুদের দূরে রাখলে তাদের মানসিক বিকাশ বিলম্বিত বা এমনকি ভোঁতাও হতে পারে। ফরাসি মা–বাবা কিংবা চিকিৎসকেরা ইনজেকশন দেওয়ার সময় অত উদ্বিগ্ন হন না। এই ব্যথা অনুভব করা যে জীবনেরই অংশ, তা তাঁরা শিশুদের শেখাতে চান সচেতনভাবেই। এর জন্য ‘সরি’ বলারও কোনো কারণ তাঁরা দেখেন না। ফরাসিদের মতে, এসব অস্বস্তি থেকে শিশুদের দূরে রাখা মানে তাদের জন্য বড় দুর্দশার মঞ্চ প্রস্তুত করা। তাই তাঁরা শিশুদের প্রয়োজনীয় ব্যথা অনুভব করতে দেন এবং ওই ব্যথা কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, তা–ও শেখান। এতে শিশুরা নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করার মতো স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে।
ফরাসি অভিভাবকেরা শিশুকে ছোট থেকেই নম্র-ভদ্র, মার্জিত হয়ে চলতে শেখান। কারও সঙ্গে দেখা হলে প্রথমে তাঁকে কীভাবে অভিবাদন জানাতে হয়, কীভাবে আলাপ শুরু করতে হয়, কেউ কিছু জানতে চাইলে কীভাবে উত্তর দিতে হয়—সবই শেখান।
দাওয়াত পেলে তা গ্রহণ করতে শেখানো হয় ফরাসি শিশুদের। আবার দাওয়াতে গিয়ে কী করা যাবে, কী করা যাবে না, এসবও শেখানো হয়। ফরাসি শিশুরা দাওয়াতে যাওয়ার আগে কিছু সময় না খেয়ে থাকে। ফলে দাওয়াতে গিয়ে যে খাবার খেতে দেওয়া হয়, তার পুরোটা শেষ করে আসতে পারে। খাবার অপচয় করা যে ঠিক নয়, এটা তারা ভালোভাবেই শেখে। তবে দাওয়াতে গিয়ে মা–বাবার কথা অনুযায়ী ভাজাপোড়া খাবার তারা এড়িয়ে চলে। ফলমূল বা শাকসবজিতেই তাদের আগ্রহ থাকে বেশি।
অনেক অভিভাবককে বলতে শোনা যায়, সন্তানকে নিষেধ করলে গ্রাহ্য করে না। কিন্তু ফরাসি মা-বাবারা এমন আক্ষেপ করেন খুব কমই। কারণ, তাঁদের শিশুরা মনে করে, মা-বাবা ‘না’ বললে তার ওপর আর কিছু বলার নেই। মা-বাবা কোনো কিছুতে অনুমতি না দিলে বা ‘না' বললে তা কখনোই ‘হ্যাঁ' হবে না—ফরাসিরা এমনটাই শেখান তাঁদের শিশুদের। প্রথম দিকে শিশুরা জেদ করলেও মা-বাবার দৃঢ়তার কাছে একসময় হার মেনে নেয়। এই অভ্যাস শিশুকে পরবর্তী জীবনে ধৈর্যশীল হতে শেখায়।
ফরাসি মা-বাবারা শিশুদের ভয়ডরহীনভাবে চলতে শেখান। তাঁরা শিশুদের কিছুটা স্বাধীনতা দিয়ে চলাফেরা করতে দেন। ফলে শিশু সহজেই বুঝে ফেলে, ঘরের চৌকাঠের বাইরের পৃথিবীটা ভয়ের নয়, খারাপ নয়। আবার একা একা চলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে শিশু বুঝতে পারে, কোথায় তাকে সাবধানী হতে হবে। এই স্বাধীনতা শিশুকে আত্মবিশ্বাসী তো করেই, সঙ্গে মুক্তমনা করে গড়ে তোলে।
শিশুর জন্মের পর থেকেই ফরাসি মায়েরা যথেষ্ট স্টাইলিশ জীবনযাপন করার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে ফ্রান্সের অন্যান্য শহরের তুলনায় প্যারিসে এর চর্চা বেশি। মায়ের স্টাইলিশ জীবনযাপন দেখে শিশু মায়ের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হতে পারে। যেহেতু শিশুর বেড়ে ওঠায় মায়ের প্রভাব থাকে বেশি, তাই মায়ের দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সন্তানের মনে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। তবে স্টাইলিশ হওয়া মানেই সব সময় ঝলমলে পোশাক পরা, ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। পোশাক যেমনই হোক, মায়ের মন যেন থাকে হাসিখুশি ও পরিপাটি, এটাই মেনে চলেন ফরাসি মায়েরা।
সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট