নানা কারণেই আপাতসুখী দাম্পত্যের ইতি ঘটতে পারে। কখনো এই বিচ্ছেদ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়, নিয়ম মেনে আইনকানুনের বেড়াজাল ডিঙিয়ে দুজন মানুষ একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে যান; আবার কখনো তীব্র মান-অভিমান, লড়াই, ঝগড়া, দোষারোপ থেকে শুরু করে মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমেও ভাঙে পরিবার।
এসব ক্ষেত্রে বিচ্ছেদ নেওয়া দম্পতির যদি সন্তান থাকে, তাহলে পরিস্থিতি হয় কিছুটা জটিল। কারণ, দুজন মানুষ যখন বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন, তখন অনেক ভেবেচিন্তে কিংবা মতের বা মনের মিল না হওয়ার কারণ থেকেই সিদ্ধান্ত নেন। স্বামী বা স্ত্রী সাবেক হয়ে যেতে পারেন, কিন্তু ওই দম্পতির যে সন্তান, তাদের জন্য তো বাবা-মা কখনো সাবেক হন না।
সে ক্ষেত্রে বিচ্ছেদ কিংবা বিচ্ছেদের পর নতুন জীবন শুরুর বিষয়টি সন্তানের সঙ্গে কীভাবে আলোচনা করা যেতে পারে? কীভাবে আলাপ করলে বিষয়টি তার জন্য পীড়াদায়ক হবে না বা তাকে তুলনামূলক কম কষ্ট দেবে?
এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন সংবাদকর্মী সুহৃদ হোসেন (ছদ্মনাম)। সুহৃদ বলেন, তাঁর মেয়ে যখন বেশ ছোট, তখনই তাঁরা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। এ ক্ষেত্রে মেয়েকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার কৃতিত্বটা সাবেক স্ত্রীকেই দিলেন তিনি। ‘মেয়ের মা তাকে প্রথম প্রস্তুত করেছিলেন। ধীরে ধীরে বলেন যে তাঁরা আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। মা আর বাবা একসঙ্গে থাকবেন না। ফলে বিষয়টি সে–ও মেনে নিয়েছিল।’
তাঁদের বিচ্ছেদের কিছুদিন পরই সাবেক স্ত্রী বিয়ে করেন। সেই বিয়েতে উপস্থিত ছিল মেয়েও। যেহেতু সে মায়ের সঙ্গেই থাকে, তাই নতুন পরিবারের সঙ্গেই তার দিন কাটে। তবে বাবার সঙ্গে দেখা করতেও কোনো মানা নেই। নিয়ম করে বাবার কাছে কয়েক দিন থেকে যায়।
কিছুদিন আগে নিজেও নতুন জীবন শুরু করেছেন সুহৃদ। তবে দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম শর্তই ছিল, নতুন সম্পর্কে যেন তাঁর মেয়ের গ্রহণযোগ্যতা থাকে। নতুন সঙ্গী যদি মেয়েকে গ্রহণ করতে না পারে, তাহলে সে সম্পর্কে জড়াবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি বলেন, ‘মেয়ে তো আমার কাছে থাকে না। কিন্তু সে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাধান্য। যে কদিন থাকতে আসে, বেড়াতে আসে, আমি তাকে সর্বোচ্চ স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার চেষ্টা করি। ব্যস এটুকুই। আমি কখনো বলি না যে আমার দ্বিতীয় স্ত্রীও তাকে মায়ের মতো ভালোবাসবেন বা তাঁকে তার মা হয়ে উঠতে হবে। কিন্তু তাকে ছোট যেন না করে, তাকে খারাপ যেন অনুভব না করায়।’
এতে বাবা-মেয়ের সম্পর্কে কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেনশন অব ক্রুয়েল্টি টু চিলড্রেন (এনএসপিসিসি) বিচ্ছেদের বিষয়ে সন্তানের সঙ্গে আলাপ–আলোচনার পরামর্শ দিয়েছে। এনএসপিসিসির নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিচ্ছেদের আগে অভিভাবকেরা সন্তানকে নিশ্চিত করবেন যে বাবা-মা দুজনই তাদের ভালোবাসেন। এটায় কোনো পরিবর্তন হবে না। সন্তান যেন বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে নিজেকে দায়ী না করে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
বেসরকারি চাকরিজীবী কঙ্কন সরকার বলছিলেন নিজের বিচ্ছেদের অভিজ্ঞতার কথা। তার সন্তান সবে যখন স্কুলে ভর্তি হয়েছে, তখনই তাদের বিচ্ছেদ হয়। সেই সন্তান এখন স্কুলের শেষ ক্লাসে। মায়ের সঙ্গেই থাকে। বাবা নতুন করে সংসার গুছিয়েছেন, তবে বাবার সঙ্গেও তার বেশ সখ্য। কঙ্কন বলেন, ‘আমি এমন কোনো কথা বলি না, যাতে মেয়ের সঙ্গে বাবার দূরত্ব তৈরি হয়। কিংবা ভুল–বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়। বাবা যখন চায় মেয়েকে নিয়ে কেনাকাটায় যায়, বাইরে খেতে যায়। আমি কখনো বাধা দিই না। মেয়ে এখনো বাবাকে দেখলে জড়িয়ে ধরে। আমাদের বিচ্ছেদের কারণে ওদের সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন আসতে দিইনি।’
তবে আলোচনা না করার কারণে সন্তানদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে, এমন উদাহরণও চারপাশে দেখা যায়।
বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মা–বাবার সন্তান জান্নাতুল নাওমী বললেন তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, ‘মা–বাবার মধ্যে মনোমালিন্য দেখেই বড় হয়েছি। সবশেষ তাঁদের কখন হাসিমুখে দেখেছি, মনে পড়ে না। ছোটবেলায় বাবা অফিস থেকে ফিরলেই আতঙ্ক লাগত। মনে হতো, এই বুঝি পান থেকে চুন খসবে আর শুরু হবে লঙ্কাকাণ্ড। তারপরও তাদের বিচ্ছেদের খবর শুনে কষ্ট পেয়েছিলাম। হুট করে এমন সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া কঠিন ছিল আমার জন্য। বিশেষ করে, লোকে কী বলবে, তা নিয়ে ভয় পেতাম। সেই থেকে বিচ্ছেদ শব্দটাই আমার জন্য আতঙ্ক। বললেন তিনি। নিজে সংসারী হয়েছেন, তবে তার আগে দীর্ঘ সময় নিতে হয়েছে মনোবিদের সহায়তা।
নওমী বলেন, ‘বাবা-মা যদি সম্পর্কটা স্বাভাবিক রেখে আমাকে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলতেন, তাহলে হয়তো আমাকে এমন আতঙ্কের জীবন কাটাতে হতো না।’
কোনো বয়সে মা–বাবার বিচ্ছেদ হলে তা সন্তানের জীবনে তেমন প্রভাব রাখে না। সে বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব নিউ মেক্সিকো হেলথ সায়েন্স সেন্টারের সহযোগী অধ্যাপক শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ স্কট ক্যারল বলেন, সন্তান যখন একদম শিশু বয়সে থাকে, তখন মা–বাবার বিচ্ছেদ হলে তার ভেতর ট্র্রমা থাকে না। সে ক্ষেত্রে বয়স হতে হবে দুই বছরের নিচে। তিনি বলেন, কোনো কোনো শিশুর দুই বছর বয়সের স্মৃতিও থেকে যায়। ফলে সে তার জীবনের এই পার্থক্যটি ধরতে পারে।
বিচ্ছেদের পর যেকোনো একজন অভিভাবক যদি শিশুর জীবন থেকে সরে যান বা যোগাযোগের বাইরে চলে যান, তাহলে তা ওই শিশুর জন্য ভীষণ কষ্টের হয়। এ ধরনের শিশুরা বিষণ্নতায় ভোগে বলেও জানান তিনি। এই বিশেষজ্ঞের মতে, বয়ঃসন্ধিকালের পর সাধারণত সন্তানেরা মা–বাবার বিচ্ছেদের বিষয়টি তুলনামূলক সহজে মেনে নিতে বা সমস্যাটি বুঝতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, তারাই বরং বিষয়টি পরিবারের অন্যদের মধ্যে সবচেয়ে আগে মেনে নেয়।
এর সঙ্গে একমত রাবেয়া নাসরিনও। মফস্সল শহরে থাকা এই নারী জানালেন, ছেলের জন্মের কিছুদিন পর থেকেই স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য হচ্ছিল। এর দুই বছরের মধ্যেই বিচ্ছেদপ্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়। এরপর দীর্ঘ সময় ছেলেকে একাই বড় করেছেন। বাবা বা দাদাবাড়ির সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক অনেকটাই আনুষ্ঠানিক। ঈদ বা ওই পরিবারে কারও বিয়ে-জন্মদিনে সে দাওয়াত পায়। অন্য সব দাওয়াতের মতোই যায়, অংশ নিয়ে চলে আসে। খুব একটা মানসিক বন্ধন সে অনুভব করে না।
রাবেয়া বলেন, বাবার সঙ্গে ভালো করে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার আগেই বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। ফলে ছেলে পরিবারের ভাঙন কী জানে না; পরিবার কেমন ছিল, সেটাই জানে না।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া এই কিশোরের মা এবার নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছেন। পরিবারের সবার সম্মতিতেই নতুন করে ঘর বাঁধতে চলেছেন। আর এ বিষয়ে তাকে সবচেয়ে সমর্থন আর উৎসাহ জোগাচ্ছে তার ছেলে।
তিনি বললেন, ছেলে হয়তো তার বন্ধুদের মা-বাবাকে দেখে শিখেছে, কিংবা হয়তো তার বাবার নতুন জীবন দেখেও বুঝেছে। সে নিজেই চায় আমার সঙ্গী আসুক, আমার জীবনে পরিবর্তন আসুক। ওর উৎসাহ দেখে মনে হয়, আসলেই নিজেকে আবার সুযোগ দেওয়া উচিত।