কে বেশি বহুগামী, নারী নাকি পুরুষ?

বহুগামিতার আকাঙ্ক্ষা মানুষের ভেতর সুপ্ত অবস্থায়ই থাকে
সংগৃহীত অলংকরণ

মানুষের বহুগামিতা কি প্রাকৃতিক?

এ বড় জটিল জিজ্ঞাসা। প্রেমিকা বা স্ত্রী কিংবা প্রেমিক বা স্বামী ছাড়া কি নর-নারী অন্য কারও প্রতি কামনা বোধ করেন না? কিংবা আরও সহজ করে বললে, মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই বহুগামী কি না—প্রশ্নটি রাখা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদের কাছে। মুঠোফোনের অপর প্রান্ত থেকে এককথায় তিনি জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই বহুগামী।’ ছোট্ট করে কারণটাও ব্যাখ্যা করলেন তিনি, মানুষ তথা যেকোনো প্রাণীর বহুগামী হয়ে ওঠার পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে তাঁর দেহ নিঃসৃত হরমোন, যাতে একই সঙ্গে তার জিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এই বহুগামিতার আকাঙ্ক্ষা মানুষের ভেতর সুপ্ত অবস্থায়ই থাকে। বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে তা প্রকাশ পায়।

বহুগামিতা ও বিশ্বস্ততা

বহুগামিতার বিপরীত ধারণা হিসেবে বিশ্বস্ততার ধারণাটি এসেছে বেশ পরে। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সমাজব্যবস্থায় আসার এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় মানুষের নানা রকম বিবর্তন ঘটেছে। বিবর্তনবাদ, বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞান—সামগ্রিক বিশ্লেষণেই আদি স্তরে মানুষের বহুগামিতার চিত্র দেখা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পদের মালিকানা, সাংস্কৃতিক বিবর্তন, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এবং সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার নীতিবোধ মানুষকে একগামী করে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। প্রথাগত সমাজব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য এবং উল্লিখিত নীতিবোধের শক্তিতে মানুষ নিজের সুপ্ত বহুগামী যৌনাকাঙ্ক্ষাকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। কিন্তু মানুষের যে আদিম, অকৃত্রিম ও প্রাকৃতিক স্বভাব, তা তো আর সমূল উৎপাটিত হয়নি। ফলে সুযোগ ও অনুকূল পরিবেশ পেলে অনেক সময়ই নৈতিকতা দুর্বল হয়ে যায় এবং সেই প্রাকৃতিক বহুগামী যৌনাকাঙ্ক্ষা নৈতিকতার ওপর কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠে।

মানুষ বহুগামী হয় কেন?

এর মৌলিক জবাব ইতিমধ্যে দেওয়া হয়ে গেছে। বরং প্রশ্নটাকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দেখা যাক। আধুনিক সমাজব্যবস্থার নানা রকম বিধিনিষেধ, ধর্ম, নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং বহুগামিতা বর্জন করে একগামিতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক অবকাঠামো, বিবিধ বিচার, শাস্তির ব্যবস্থা প্রভৃতি থাকার পরও মানুষ সঙ্গীর প্রতি অবিশ্বস্ত হয় কেন? কেন হয় বহুগামী? এ ক্ষেত্রে শুরুতেই মানুষের মস্তিষ্কের কর্মপ্রক্রিয়াকে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। মানবমস্তিষ্কের সম্মুখভাগে অবস্থিত প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স ব্যক্তির নৈতিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং একজন ব্যক্তি বহুগামী হবেন নাকি একগামী, তা তাঁর প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের শক্তির ওপরও কিছুটা নির্ভর করে। বিবেচনায় আসতে পারে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের সহজাত আকর্ষণের ব্যাপারটিও। তাৎক্ষণিক আনন্দ বা চটজলদি সুখের নেশায় মানুষ অনেক সময় অন্য নারী বা পুরুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। আবার পরস্পরকে যথেষ্ট সময় না দেওয়া কিংবা সম্পর্ককে যত্ন না করাও গুরুত্বপূর্ণ কারণ। অন্যদিকে প্রতিদিন যদি পারস্পরিক যত্নের মাধ্যমে সম্পর্ককে অধিকতর রোমান্টিক করে তোলা না যায়, সে ক্ষেত্রে সঙ্গীর প্রতি একঘেয়েমিও চলে আসে। এই একঘেয়েমি থেকেও কেউ কেউ বহুগামী হতে পারেন।

কে বেশি বহুগামী?

অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন স্পষ্টভাবেই জানান, ‘বহুগামিতার ক্ষেত্রে নারী বা পুরুষের কম-বেশি তুলনা করার সুযোগ নেই। উভয়ের ভেতরই বহুগামিতার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। আমাদের সমাজব্যবস্থায় পুরুষকে তুলনামূলক বেশি বহুগামী হতে দেখা যায় মূলত পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে।’ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতা ও সম্পদের মূল কর্তৃত্ব পুরুষের হাতে। অন্যদিকে সম্পদের উত্তরাধিকারের প্রসঙ্গ নিশ্চিত করতে নারীর বহুগামিতাকে দমন করা হয়। ফলে পুরুষের বহুগামিতাকে যতটা সহনশীল চোখে দেখা হয়, বিপরীতে ঠিক ততটাই ঘৃণার চোখে দেখা হয় নারীর বহুগামী মানসিকতাকে। আবার যৌনতার ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ সমান আনন্দ লাভ করলেও এর প্রত্যক্ষ ফলাফল দেখা যায় নারীর শরীরে। তাঁর দেহে নতুন প্রাণের আগমন ঘটে। দীর্ঘ ৯ মাস সেই প্রাণকে বহন করতে হয়। লালনপালনের মূল কাজটিও নারীকেই করতে হয়। মাতৃত্বের এই মানবিক ব্যাপার নারীকে একগামী করে রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।

বহুগামিতা ও বিবাহপ্রথা

বহুগামিতা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিয়ে এক দারুণ কার্যকর প্রথা হিসেবে যুগ যুগ ধরে টিকে আছে। এমনকি বলা যায়, বিয়ের মতো সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তির অন্যতম প্রধান কারণ হলো মানুষকে একগামী করে রাখা। এ প্রসঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে একগামী করে তোলার জন্য যেসব সামাজিক চুক্তির বিকাশ ঘটেছে, বিবাহপ্রথা তার অন্যতম। কিন্তু এটিই একমাত্র নয়। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে মানবসমাজে বহুগামিতা নিয়ন্ত্রণে বিবাহপ্রথা খুবই শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে থাকে।’ বস্তুত বিয়ে নিছক সামাজিক চুক্তিই নয়, বরং পারস্পরিক বিশ্বাস, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার একটি সম্পর্ক। ফলে দেখা যায়, যাঁরা বিবাহপ্রথার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাশীল, তাঁদের ভেতর বহুগামিতার প্রবণতা নেই বললেই চলে।