বিয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক কী? উত্তরটা জানার আগে জাদুমঞ্চের সামনে বসে বন্ধুর সঙ্গে জাদু প্রদর্শনী দেখা যাক। মঞ্চে দাঁড়ানো জাদুকর, হাতে একটি গোলাপ ফুল। পাপড়িতে ফুঁ দিতেই ফুলের ভেতর থেকে শান্তি ছড়িয়ে আকাশে উড়ে গেল সাদা পায়রা দম্পতি। এটা দেখে পাশে বসা যে বন্ধুটি হেসে উঠলেন, তিনি জানেন তাঁর ভূমিকাও এই জাদুকরের মতোই। কারণ, সবাই হয়তো জানেন, পিঠে হাত বুলিয়ে সমূহ হাহাকার ভুলিয়ে দেওয়া নাবিকের নাম বন্ধু। যে কিনা তুড়ি মেরে হাওয়ায় মিলিয়ে দিতে পারে মন খারাপ।
কিন্তু সামিনের (ছদ্মনাম) হাহাকার ভুলিয়ে দেওয়ার বদলে বাড়িয়ে দিয়েছে বন্ধু। সামিনের সবচেয়ে ভালো এই বন্ধুটির নাম নিকোল (ছদ্মনাম)। একসময় তাঁর সঙ্গে প্রেমও হয়েছিল। সেই প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি। যৌথ আলোচনায় প্রেম ভুলে তাঁরা আবার বন্ধুত্বের সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছিলেন। পরে পরিবারের পছন্দে বিয়ে করে সংসারজীবনে ঢুকে পড়েন সামিন। কিন্তু একসময় ট্যুরে যাওয়ার সঙ্গী নিকোলের সঙ্গে আগের মতো না হলেও অল্পবিস্তর যোগাযোগ হতে থাকে। তবে ‘কেমন আছ?’ ‘জীবন কেমন চলছে’—এটুকু জানার মাঝেই অনেকটা সীমাবদ্ধ ছিল তাঁদের বন্ধুত্ব। আর মাসে হয়তো একবার অফিসফেরত পথে কফিশপে ঘণ্টাখানেকের আড্ডা। প্রেম না থাকলেও যেদিন দেখা হতো, সেদিন বাসায় ফিরে আনমনা হয়ে থাকতেন সামিন। বিষয়টি তাঁর স্ত্রী বুঝতে পারলে শুরু হয় দাম্পত্য কলহ। সামিন না পারেন স্ত্রীকে বোঝাতে, না পারেন নিকোলকে বলতে যোগাযোগ বন্ধ করতে। কলহ ধীরে ধীরে জটিল হয়ে ওঠে। বিষিয়ে ওঠে দুজনের জীবন। দাম্পত্য জটিলতার অবসানের জন্য পারিবারিক মধ্যস্থতায় সামিন ও তাঁর স্ত্রী বর্তমানে কিছুদিনের জন্য আলাদা থাকছেন। সামিনের বুকের ভেতর এখন হাহাকারের হাওয়া। কোনো বন্ধুকেই আর তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না, যে কিনা এই হাহাকার ভুলিয়ে দিতে পারেন।
সামিন বলেন, ‘ছোট্ট একটা বিষয় যে এত দূর গড়াবে, বুঝতে পারিনি। এখন মনে হয়, বিষয়টা আগে থেকে স্ত্রীকে জানানো উচিত ছিল। তাহলে হয়তো সহজ হতো সবকিছু। বিষয়টা এত জটিল হয়েছে যে কোনো বন্ধুই আর পাশে থেকে সমাধান দিতে পারছে না।’
এমন বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী এবং সম্পর্ক ও অনলাইন ডেটিং বিশেষজ্ঞ জেসিকা কারবিনো বলেছেন, বিয়ের পরে বন্ধুত্ব রাখার ক্ষেত্রে প্রাক্তনের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু ছিল, তা বিবেচনায় রাখতে হবে। না হলে ঝামেলা হতে পারে। কারণ, দীর্ঘ প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর প্রাক্তনের সঙ্গে স্রেফ বন্ধুত্ব রক্ষা করা কঠিন। কোনো কোনো বন্ধু ঈর্ষা বা প্রতিশোধপরায়ণও হতে পারেন। ঝামেলা বাড়ানোর চেয়ে তাই প্রাক্তনকে এড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ।
বিয়ের পর বন্ধুত্বের সীমারেখা নির্ধারণ করা জরুরি। দুই পক্ষকেই বিষয়টা বুঝতে হবে। আর প্রাক্তনকেও অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর সুযোগ দিতে হবে। নিজের পারিবারিক সম্পর্কের প্রতিও সৎ থাকতে হবে। তাহলে সব সম্পর্কই সাবলীল হবে। যেমনটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হিমি–শাবাব দম্পতির (ছদ্মনাম) ক্ষেত্রে ঘটেছে।
হিমি ও শাবাবের প্রেমের বিয়ে। বয়সে একটু বড় শাবাবের আগের বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে এখনো ভালো সম্পর্ক, হিমিরও তা–ই। আবার দুজনের বন্ধুর সঙ্গে দুজনেরই সম্পর্ক বেশ ভালো। ছুটির আগের রাতে দুজনই দুজনের বন্ধুর সঙ্গে অনলাইনে দল বেঁধে গেম খেলেন। আগের মতো সম্ভব না হলেও এখনো বন্ধুদের সঙ্গে সুযোগ পেলে ঘুরতে যান। হইহুল্লোড়ে মেতে থাকেন। তাঁদের কাছে পরিবারের মতোই সম্পর্কের স্তরভেদে বন্ধুত্বও সমান গুরুত্ব পায়।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা হিমি বলেন, ‘স্বামী-সংসার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, স্তরভেদে বন্ধুরাও তেমন। এই বন্ধুত্বে বিশেষ বলে কিছু নেই। সংসারের সবকিছু ঠিকঠাক রেখে যতটুকু সম্ভব বন্ধুত্ব অটুট রাখার চেষ্টা করি। আমার ছেলে বন্ধু নিয়ে শাবাবের তেমন কোনো আপত্তি নেই, তাঁর মেয়ে বন্ধু নিয়ে আমারও কোনো সমস্যা নেই। আমরা একে অপরের সবকিছু জানি। সম্পর্কের ব্যাপারে সৎ থাকলে ঝামেলা হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। বন্ধুদের সঙ্গে এখন আর তেমন দেখা হয় না। কিন্তু অনলাইনে কথা হয়, অনলাইনে গেম খেলি, হই হই করি। বছরে হয়তো একবার পরিকল্পনা করে ঘুরতে যাই। আমরা আসলে সম্পর্কের সীমারেখাটা বুঝি। এতেই আমাদের আনন্দ।’
শাবাবও বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘বিয়ের আগে হোক আর পরে, জীবনে বন্ধু থাকাটা জরুরি। বন্ধু ছেলে বা মেয়ে যে–ই হোক—বন্ধু বন্ধুই। তবে বোঝাপড়াটা ঠিক থাকতে হবে। পরিবারে থেকে জীবনের সব কথা স্ত্রীকে বলা যায় না, সেসব কথা বলার জন্য অন্তত একজন ভালো বন্ধু দরকার, এতে স্বস্তি মেলে।’
সামাজিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কবিষয়ক মার্কিন জার্নাল সেজ জার্নালে ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘ডাজ সিঙ্গেলহুড আইসোলেট অর ইন্টিগ্রেট?’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিবাহিত ব্যক্তিদের তুলনায় অবিবাহিতদের বন্ধু বেশি।
তাহলে কি বিবাহিতদের বন্ধু থাকতে নেই? এর জবাব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ক্লোয়ি কারমাইকেল। তিনি বলেছেন, বিয়ের পর মানুষের দায়িত্বের পরিবর্তন হয়। বিবাহিত মানুষকে পরিবার ও বন্ধু দুটো বিষয়কে বুঝতে হয়। কিন্তু অবিবাহিত বন্ধু অন্য বন্ধুর পরিবারের গুরুত্বটা ঠিক সেভাবে বুঝবে না। এ কারণে ঝামেলার সৃষ্টি হয়। এভাবে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব মলিন হয়ে যেতে পারে। এটা স্বাভাবিক বিষয়, এটার জন্য অপরাধবোধে ভোগার কিছু নেই। এরপরও যাঁরা বন্ধুত্ব রাখতে চান, সম্পর্কের ব্যাপারে তাঁদের সৎ থাকতে হবে। পরিবারকে গুরুত্ব দিয়ে বন্ধুত্বের যত্ন নিতে হবে। পরিবারকে বন্ধু ও বন্ধুকে যতটুকু সম্ভব পরিবার সম্পর্কে জানাতে হবে। পারিবারিক একান্ত ঝামেলার বিষয়গুলো বন্ধুকে না জানানোই ভালো।
বন্ধুত্ব ও সংসার—দুটিই যিনি সামলাতে চান, তাঁর জন্য পরামর্শ: পরিবারে তাঁর সীমাবদ্ধতার কথা বন্ধুকে বুঝিয়ে বলতে হবে আর বন্ধুর বিষয়ে পরিবারকেও জানাতে হবে সঠিক তথ্য। মনে রাখতে হবে—বন্ধুত্বে অন্য দাবি রাখতে নেই। বন্ধু মানে চারদিকে শনশন হাওয়া। আর এর মধ্যে শুধু বুকভরে শ্বাস নেওয়া।