ফারজানা সুলতানাদের শ্বশুরবাড়িতে একটা অলিখিত নিয়ম ছিল। ঈদের দিন নামাজ পড়ে এসে সবার আগে শ্বশুর খাবে। এরপর অন্যরা। শ্বশুরের খাওয়ার আগে কেউ দানাপানি স্পর্শ করতে পারবে না। দীর্ঘদিন ধরে এমনটাই চলে আসছিল। বিয়ের পর প্রথম ঈদে বাড়ির বড় বউ ফারজানা সকালবেলা উঠেই যথারীতি শাশুড়ির সঙ্গে মিলে সেমাই, পায়েস, খিচুড়ি, মাংস রান্না করলেন। টেবিলে শ্বশুরের খাবার রেডি করে রাখলেন। ততক্ষণে বেশ ক্ষুধা পেয়েছে। ফারজানার আবার লো প্রেশার। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কিছু খেতে হয়। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে ক্ষুধায় প্রেশার নেমে হাত-পা কাঁপতে লাগল। শ্বশুরসহ বাড়ির ছেলেরা ঈদের নামাজে গেছেন। ফিরতে কতক্ষণ কে জানে! এমন পরিস্থিতিতে একফাঁকে শাশুড়ি এসে ফারজানাকে মুখে তুলে খাইয়ে গেলেন। আর বললেন, ‘তুমি কিন্তু নিজে খাও নাই। আমি খাওয়ায়ে দিছি। বুঝলা?’ একঝটকায় দীর্ঘদিনের প্রথা গেল ভেঙে। মহামারিতে ফারজানার স্বামী মারা গেলেন। পোস্ট–কোভিডে মারা গেলেন শ্বশুর। দুই পুত্রের মা ফারজানা আর তাঁর শাশুড়ি দুজনে এখন সময় পেলেই ঘুরে বেড়ান। ছুটির দিনে রুফটপ রেস্তোরাঁয় নুডলস আর ফালুদা খেতে খেতে আড্ডা দেন বন্ধুর মতো। বউ-শাশুড়ি দুজন দুজনের ওপর ভর করে এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবনের দুঃখ–সুখ ভাগাভাগি করে যাপন করছেন।
তবে এমনটা সব বউ-শাশুড়ির ক্ষেত্রে ঘটে না।
ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে একটা লেখায় চোখ আটকে গেল। মূল বক্তব্য অনেকটা এ রকম যে আমরা সব সময় একটা মেয়েকে শেখাই, কীভাবে ভালো বউ হতে হবে, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে নতুন পরিবেশে সবার সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে। নতুন বউকে এ বিষয়ে উপদেশ দেওয়ার লোকের অভাব নেই।
অন্যদিকে ‘রাতারাতি’ যিনি শাশুড়ি বনে যাচ্ছেন, তাঁকে কেউ বলে না, কীভাবে ভালো শাশুড়ি হতে হবে, কীভাবে বউয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে, কীভাবে নতুন বউকে পরিবারের কর্ত্রী হিসেবে আপন করে নিতে হবে। অথচ নতুন মেয়েটিকে সর্বোচ্চ ইতিবাচক মনোভাব দিয়ে আপন করে নিতে পারার কথা তো এই শাশুড়িরই।
বেশ কয়েকজনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করি। কলেজশিক্ষক হালিমা আক্তার দুই ছেলের মা। বড় ছেলের জন্য বউ খুঁজছেন। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম তিনি কীভাবে তাঁর ছেলেবউকে আপন করে নেবেন। বললেন, ‘আমি কোনো উচ্চাশা রাখি না। আমার ছেলে সকাল ১০টা পর্যন্ত ঘুমালে যদি অসুবিধা না হয়, তাহলে ছেলেবউ দেরি করে উঠলে কেন দোষ খুঁজব? ভুল আমরা প্রত্যেকে করি। দোষ-গুণ নিয়েই মানুষ। সেগুলোকে নিজের সন্তানের মতোই সহজ করে দেখতে চাই।’ স্কুলশিক্ষক আর্জিনা জলিও মনে করেন এই বাংলায় আবহমানকাল থেকে চলে আসা বউ-শাশুড়ির চিরন্তন সম্পর্কে শাশুড়ির ভূমিকাই মুখ্য। বললেন, ‘মান-অভিমান কি মা-সন্তানের মাঝে হয় না? সব সম্পর্কে হয়। মিটমাট করতে অগ্রজকেই এগিয়ে আসতে হবে।’ জানতে চাইলাম, ছেলের বউকে কি আসলেই মেয়ের মতো করে দেখা সম্ভব? বললেন, ‘শতভাগ হয়তো সম্ভব না। কিন্তু ৮০ ভাগ তো সম্ভব। আন্তরিকতা নিয়ে চেষ্টা করে দেখতে দোষ কোথায়?’
পেশায় চিকিৎসক লামিয়া জান্নাতের তিন বছরের সংসার। স্বামীও চিকিৎসক। প্রেমের বিয়ে। মেডিকেল কলেজে পড়ার দিনগুলো থেকেই প্রেম। শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্ক অম্লমধুর। তবে সময়ের সঙ্গে অম্লের পরিমাণ কমেছে। বেড়েছে মধুর ভাগ। কীভাবে? জানতে চাইলে একটা মজার কথোপকথনের গল্প বললেন লামিয়া। জানালেন, শুরুতে খানিকটা নাকানিচুবানিই খেতে হয়েছে। কেননা, কমবেশি সব মা–ই ছেলেকে নিয়ে কিঞ্চিৎ ‘ইনসিকিউরিটি’তে ভোগেন। লামিয়াই উদ্যোগী হয়ে শাশুড়িকে নিয়ে মাঝেমধ্যে কেনাকাটা করতে যান। পেশাগত দায়িত্ব সামলে সময় পেলেই শাশুড়িকে ডেকে চা নিয়ে নাটক দেখতে বসেন। একদিন গল্পগুজবের একফাঁকে লামিয়া তাঁর শাশুড়িকে সাহস করে কথাটা বলেই ফেললেন।
‘আম্মা, আপনাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি। বলুন তো, আপনি যদি আমাকে “প্যারা” দেন, সেই প্যারা আমি কাকে ফিরায়ে দেব? নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে এর তো একটা সমান আর বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকবে। সেই প্রতিক্রিয়া আমি কার ওপর দেখাব?’
এরপর কয়েক সেকেন্ডের পিনপতন নীরবতা। তবে শাশুড়ি ধাঁধায় জিতেছিলেন, আস্তে করে খানিকটা জিজ্ঞাসামিশ্রিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেকে?’ তখন লামিয়া বলেছিল, ‘জি, আপনার ছেলের সঙ্গে অশান্তি হবে। কিন্তু আমরা দুজনেই তো ওকে ভালোবাসি, ওর ভালো চাই।’
এরপর থেকে দুজনে অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছেন। যেকোনো সংকটে দুজন দুজনের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করে সমাধান খোঁজেন। লামিয়ার মতে, শাশুড়িরাও একসময় বউ ছিলেন। তাঁদের সেই অভিজ্ঞতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভালো না। তাই তাঁরাও মনের অগোচরে (সাবকনশাস মাইন্ডে) অপেক্ষা করেন যে কবে তাঁরা শাশুড়ি হবেন আর ‘পাওয়ার প্র্যাকটিস’ করবেন। আমরা যাঁরা শিক্ষিত, সচেতন, তাঁদেরই এ ক্ষেত্রে খোলামনে এগিয়ে আসতে হবে শাশুড়িদের ভুল ভাঙাতে। কেননা আমরা আসলে দুই পক্ষ নই। আমরা এক পক্ষ। কেননা আমাদের ভালোবাসার ব্যক্তিতে মিল, পারিবারিক একতায় মিল। দুজনেই সংসারে শান্তি চাই।
জীবনযাপনভিত্তিক সাইট মার্থা স্টুয়ার্টে ‘হাউ টু বি আ গ্রেট মাদার ইন ল’তে ভালো শাশুড়ি হওয়ার দায় কেবল শাশুড়ির ওপর নয়, বরং ছেলে, ছেলের বউ এবং শ্বশুরের ওপরও বর্তানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সাধারণত কোনো সম্পর্কই এককভাবে ভালো বা খারাপ হয় না। সেখানে দুই পক্ষেরই কমবেশি ভূমিকা থাকে। এমনকি পারিপার্শ্বিক সম্পর্ক আর পরিস্থিতিও প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে মা আর বউ সম্পর্কের ভারসাম্যে ছেলের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
‘হাউ টু বি আ গুড মাদার ইন ল’ বলে আপনি যদি গুগল করেন, তাহলে যে পরামর্শগুলো আসে, সেগুলোর ভেতর সবচেয়ে জনপ্রিয় ১০টি তুলে ধরা হলো—
১. মেনে নিন, আজ (ছেলের বিয়ের দিন) থেকে মা হিসেবে ছেলের প্রতি আপনার ভূমিকা বদলে গেছে। ছেলে-বউকে আপন করে নিতে অভিজ্ঞতায় এগিয়ে থাকা শাশুড়িকেই প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্য পরিবার, সংস্কৃতি, পরিবেশ থেকে আসা একটা মেয়েকে উষ্ণ আমেজে অভ্যর্থনা জানাতে হবে।
২. প্রতিটা শাশুড়িকে নিজেকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, বউ হিসেবে যেসব অন্যায়ের মুখোমুখি তিনি হয়েছেন, তাঁর ছেলেবউয়ের ক্ষেত্রে তিনি সেটা হতে দেবেন না। তবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
৩. অনেক সময় নিজের স্বামী বা সন্তানেরাই প্রত্যাশা মেটাতে ব্যর্থ হন। তাই অন্য পরিবার থেকে আসা মেয়েটির কাছে প্রত্যাশার পারদ কমিয়ে রাখাই সমীচীন। প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা যেখানে বেশি থাকে, সেখানেই গুটিসুটি মেরে অপেক্ষা করে ভোগান্তি।
৪. ক্ষমা করতে শিখুন।
৫. সংকটে খোলামনে আলাপ করুন।
৬. স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্যে নিরপেক্ষ জায়গা থেকে বিচার করুন।
৭. পারতপক্ষে ছেলের সংসারে, ব্যক্তিগত বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন।
৮. হুট করে কোনো পরিবর্তন আশা করবেন না। সময় নিন। সময় দিন। ধৈর্য ধরুন।
৯. পুত্রবধূর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, মুহূর্তগুলো মনে রাখুন।
১০. কথা বলার সময় ইতিবাচকতা ধরে রাখুন।