চল্লিশের পরে যেভাবে বদলে যায় বন্ধুত্বের সংজ্ঞা

চল্লিশের পরের বন্ধুত্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আস্থা দেয়, ভরসা দেয়, সাপোর্ট দেয়।
ছবি: কবির হোসেন

‘বন্ধু তোমায় এ গান শোনাব বিকেলবেলায়

আর একবার যদি তোমাদের দলে নাও খেলায়…’

একটা বয়সের পর এই গান শুনে স্মৃতিকাতর হন না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। কথায় বলে, বন্ধুহীন জীবন মরুভূমির মতো। তারপরও জীবনের ব্যস্ততা আর বাস্তবতায় একটা সময় পর বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হতে শুরু করে।

বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে এটা দেখা যায় বেশি। স্বামী, সন্তান, সংসার—এই তিন ‘স’–এর পাল্লায় পড়ে অনেকে তো ভুলতেই বসেন যে এককালে জীবন ছিল বন্ধুবেষ্টিত। বন্ধুরাই ছিল অক্সিজেন।

এই বয়সের বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে অনেক গোছানো, অনেক পরিণত।

অবশ্য বয়সের সঙ্গে প্রাধান্যের তালিকা যেমন বদলাতে থাকে, তেমনি বন্ধুত্বের সংজ্ঞাও কিন্তু বদলে যায়। ২০ বছর বয়সের বন্ধুত্ব আর চল্লিশের বন্ধুত্বের আবেগ যে এক হবে না, সেটা মানতেই হবে। চল্লিশের বন্ধুত্ব হবে অনেক গোছানো, অনেক পরিণত।

একটি গবেষণা সংস্থার কর্মী আফসানা ইয়াসমিনের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল। উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপের একটি দেশে রয়েছেন তিনি। সদ্য চল্লিশ পেরোনো এই নারী বলছিলেন, এখন বন্ধুত্ব মানে মনের আগল খুলে দেওয়ার জায়গা। সংসার, চাকরি, জীবনের নানা যুদ্ধের সব কথা যেখানে বলা যাবে। যেখানে কেউ কাউকে ‘জাজ’ করবে না, কেউ কারও ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে না।

আফসানা বলেন, এখন বন্ধুত্ব হয় মনের সঙ্গে মন মিলিয়ে। পেশা, সামাজিক মর্যাদা, সময় বা পথের দূরত্ব কিছুই তাতে বাদ সাধতে পারে না।

‘এখন তো আর নোট বা সাজেশন নিয়ে গোপনীয়তা নেই কিংবা কেউ কারও প্রেমের খবর বাড়িতে বলে দেওয়ার ভয় নেই। সবাই আমরা নিজেদের জীবন গুছিয়ে নিয়েছি। সম্পর্কে তাই রেষারেষি বা হিংসার স্থান নেই। বরং নির্মল আড্ডা, মন খুলে কথা বলা, দেশ-জাতি-রাজনীতি থেকে শুরু করে শাড়ি-গয়নার আলাপেও আমরা স্বচ্ছন্দ। এটাই এই বয়সের বন্ধুত্বের আসল সৌন্দর্য।’

স্কুল-কলেজের বন্ধুত্বে যেমন বড় হওয়ার তাড়া থাকে, চল্লিশের পর বন্ধুত্বে সে রকম আর থাকে না।

চল্লিশের কাছাকাছি পৌঁছেছেন কবি ও লেখক রিমঝিম আহমেদ। এই বয়সের বন্ধুত্ব সম্পর্কে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেন, সুন্দরে, সুখে, আনন্দের দিনে সবাই পাশে থাকে। দুর্দিনের একাকিত্ব খুব একান্ত। শুধুই নিজের। মানুষ ছায়াটিও মাড়ায় না। আবার এ-ও তো সত্য, যে এক-দুজন থাকে, তাদের থাকাটাই মৌলিক। নিঃস্বার্থ, চিরবন্ধু প্রাণ।

রিমঝিমের মতে, বন্ধু সে-ই, যে চট করে ঠিক-ভুল বিচার করতে বসে না। বরং পাটি পেতে দেয়, আন্তরিক ভঙ্গিতে গল্প করার মন তৈরি করে দেয়।

রিমঝিম বলেন, ‘বন্ধু আমার কাছে তেমনই এক গাছ, যার ওপর হেলান দিয়ে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। মনের গুমোট পরিস্থিতিতে একটা নির্জন জানালা ভেবে যার দিকে দৃষ্টি রাখা যায়। এমন বন্ধু সবারই হয়তো থাকে দু–একজন।’

চল্লিশ পেরোনো বন্ধুত্ব মানে মনের আগল খুলে দেওয়ার জায়গা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফারজানা আফরিনের মতে, চল্লিশের বন্ধুত্ব আসলে একধরনের বোঝাপড়ার পথচলা। অনেকটা সমঝোতারও। যারা সম্মান করে, যাদের ভারসাম্যপূর্ণ পথ চলার মতো পরিপক্বতা আছে, যাদের সঙ্গে চলাফেরায় স্বস্তি হয়, তাদের সঙ্গেই কেবল চলা যায়।

কম বয়সের আবেগে ভেসে যাওয়া হয় না বলে ফারজানার মতে, এই বয়সের বন্ধুত্বে কেউ কারও খুব বেশি ক্ষতি করতে পারে না।

ফারজানা বলেন, এই বয়সে প্রত্যাশা কম বলে দুঃখের বোঝা কম থাকে। বরং চল্লিশের পরের বন্ধুত্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আস্থা দেয়, ভরসা দেয়, সাপোর্ট দেয়।

উদ্যোক্তা ও শিল্পী শাহনাজ সুলতানার কাছে বন্ধুত্ব হলো, নানা দায়িত্বের বোঝা একপাশে রেখে নিজের জন্য একটু সময় বের করা। তিনি বলেন, ‘এখন বন্ধুরা সমালোচনা করি, নিরেট হাসিঠাট্টাও করি। একজন আরেকজনের কাছ থেকে লাইফ স্কিল শিখি। ভিডিও কল বা কফির কাপে আড্ডা, যেটাই হোক না কেন; সময়টাকে সেল্ফ প্যাম্পারিংয়ের সময় মনে হয়।’

চল্লিশের বন্ধুত্ব আসলে একধরনের বোঝাপড়ার পথচলা

স্কুল-কলেজের বন্ধুত্বে যেমন বড় হওয়ার তাড়া থাকে, চল্লিশের পর বন্ধুত্বে সে রকম আর থাকে না। ছোটবেলায় বন্ধুদের সামনে ভিন্নমত প্রকাশ করা যেত না, তাতে আড়ি জুটত কপালে। এখন বরং আলোচনা করা যায়, বিতর্কও করা যায়।

শাহনাজ বলেন, ‘এখন আমি বন্ধুদের সঙ্গে বুড়ো হওয়ার স্বপ্ন দেখি। বুড়ো হওয়ার পর নিজেরা মিলে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। সন্তানের সঙ্গে কেমন আচরণ করব, সেটা যেমন বন্ধুদের কাছ থেকে শিখি; তেমনি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে বিভ্রান্তি থাকলে সেটাও পরিষ্কার করে নিতে পারি।'