ভাইবোনের (ভাই-ভাই বা বোন-বোনের) মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বা ‘সিবলিং রাইভ্যালরি’ একটি স্বাভাবিক ঘটনা। প্রায় পরিবারেই এটা দেখা যায়। বিশেষ করে বাচ্চারা যখন ছোট থাকে, তখন এ ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা খুবই সাধারণ।
ভাইবোনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিভিন্ন কারণেই হতে পারে। এটি কখনো হতে পারে নিছক বয়সের খুনসুটি বা খেলনার কারণে, আবার কখনো হতে পারে মা–বাবার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। কখনো আবার এটি হতে পারে শুধু একজন অন্যজনের চেয়ে ভালো হওয়ার বা ভালো প্রমাণের চেষ্টার ফলাফল। তবে যা–ই হোক না কেন, এটি একটি জটিল মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।
মা–বাবা হিসেবে, এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সমাধান করা একটি চ্যালেঞ্জ। প্রথমত, এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া এবং এটি শিশুর মানসিক বিকাশের অংশ। মা–বাবা হিসেবে আপনাকে এমনভাবে কাজ করতে হবে, যাতে তারা একে অপরকে সম্মান করে, ভালোবাসে আর সম্পর্কের খাতিরে সমঝোতা করতে শেখে। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর পারিবারিক পরিবেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
কাদের বেশি হয়?
সাধারণত কাছাকাছি বয়সের শিশুদের একে অন্যের সঙ্গে তুলনা করার ভুল মানসিকতা থেকে এটা হয়ে থাকে। নিজেকে বেশি ভালো ও যোগ্য প্রমাণ করার চেষ্টা থেকে তৈরি হয় ব্যবধান। সেখান থেকে একসময় মনের বিচ্ছেদ হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। বয়সের ব্যবধান বেশি হলেও এই প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়।
এই ঈর্ষার মূলে থাকতে পারে বিভিন্ন কারণ
১. মনোযোগ আকর্ষণ: মা–বাবার ভালোবাসা ও মনোযোগ পেতে প্রতিযোগিতা অন্যতম প্রধান কারণ।
২. আত্মমূল্যবোধ: নিজের আত্মমূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন থাকলে নিজেকে অন্য ভাইবোনের সঙ্গে তুলনা করে হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারে। সেখান থেকে তৈরি হতে পারে ঈর্ষা।
৩. আকাঙ্ক্ষা: নিজের যোগ্যতা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় ঈর্ষার ভাব দেখা দিতে পারে।
৪. পক্ষপাত: অনেক সময় মা–বাবার অজান্তেই এক ভাই বা বোনের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ অন্যের ঈর্ষার কারণ হতে পারে।
শুধু ছোটবেলায়ই যে ভাইবোনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব জন্মায় তা কিন্তু নয়। বড় হওয়ার পরও ভাইবোনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দিতে পারে। বড় হয়ে যাওয়ার পর কেন ভাইবোনদের ভেতর ঈর্ষা দেখা দেয়? প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভূমিকা রাখতে পারে বেশ কিছু বিষয়:
ব্যক্তিগত সাফল্য-ব্যর্থতা: ভাইবোনের নিজস্ব সাফল্য, ব্যর্থতা, আত্মবিশ্বাস, সন্তুষ্টি—এই সবকিছুই প্রভাব ফেলে। কে তার জীবনকে কীভাবে পরিচালনা করছে এবং কতটা সফল হচ্ছে তার প্রতিফলন ঘটে পারিবারিক সম্পর্কে। এই প্রভাবের নেতিবাচক দিক হিসেবে ভাইবোনের মধ্যে দেখা দিতে পারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
মানসিক স্বাস্থ্য: উদ্বেগ, মানসিক চাপের মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে ব্যক্তি প্রায়শই তার সম্পর্কগুলোকে জড়িয়ে ফেলে। এর একটি সরাসরি উদাহরণ হতে পারে সিবলিং রাইভ্যালরি।
তুলনা: অনেক সময় মা–বাবা একই ভাইবোনকে একে অপরের সঙ্গে তুলনা করেন, যা তাদের মধ্যে ঈর্ষা তৈরি করে।
সম্পদ: সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়েও হতে পারে ভাইবোনের বিরোধ, দ্বন্দ্ব, ঈর্ষা।
মানুষ মাঝেমধ্যে নিজের ব্যর্থতার কারণ বা রাগ ঝাড়ার জন্য একটা জায়গা খোঁজে। একই পরিবারে একই পরিবেশে বেড়ে ওঠায় এই স্থানটি অনেক সময় ভাইবোন হয়ে দাঁড়ায়। কোনো কোনো ভাইবোনের মধ্যে এমন এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়, যার শুরুটা কেউই করে দেয়নি। তারপরও জীবনভর এই প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। চাইলেই থামানো সম্ভব, কিন্তু থামানো হয় না। কেবল গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাওয়া চলতে থাকে।
মা–বাবার জন্য পরামর্শ
সন্তানদের মধ্যে সমানভাবে মনোযোগ দিন।
তাদের মধ্যে পার্থক্য মেনে নিন। তাদের ব্যক্তিত্বকে সম্মান করুন।
প্রত্যেক সন্তানই আলাদা। তাদের সেই অনন্যতাকে উদ্যাপন করুন।
তাদের একে অপরকে সহায়তা করতে এবং সহযোগিতামূলক আচরণ শিখতে উৎসাহিত করুন।
ঝগড়া হলে ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি সামাল দিন এবং নিরপেক্ষভাবে সমাধান করুন।
ভাইবোনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা একটি সাময়িক বিষয়। মা–বাবার সঠিক দিকনির্দেশনা ও মনোযোগে এটি সমাধান করা সম্ভব।
ভাইবোনের মধ্যে একটি মজবুত ও সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। তবে সবকিছুর মতো এটারও মাত্রা আছে, সম্পর্কের অবনতি, কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া কিংবা দীর্ঘমেয়াদি অস্বাভাবিক আচরণকে অবশ্যই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত। ছোটবেলায়ই শিশু-কিশোর মনোরোগ নিয়ে কাজ করেন এমন নিকটস্থ বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন। বড় হয়ে যাওয়ার পরও অবস্থা বুঝে মনোবিদের পরামর্শ নিতে পারেন বা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন।
ডা. টুম্পা ইন্দ্রানী ঘোষ, সহকারী অধ্যাপক, শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ।