সম্পর্কে গোস্টিংয়ের মতো কাপুরুষোচিত আচরণ খুব কমই হয়! কোনো যুক্তিতেই গোস্টিংকে বৈধতা দেওয়া যায় না
সম্পর্কে গোস্টিংয়ের মতো কাপুরুষোচিত আচরণ খুব কমই হয়! কোনো যুক্তিতেই গোস্টিংকে বৈধতা দেওয়া যায় না

‘গোস্টিং’য়ের শিকারদের মানসিক অবস্থা কেমন হয় জানেন?

বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে আমার বন্ধু নীল (ছদ্মনাম) এক মেয়েকে ভালোবাসত। দুজনেই সমবয়সী। সেই মেয়ের অন্য এক লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। নীল তখনো ছাত্র, চাকরি হয়নি। সেই সময় নীল মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। পরের তিন বছরে সে আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে পারেনি। একদিন আমার আরেক বান্ধবী মননের (ছদ্মনাম) সঙ্গে নীলের প্রথমে মেসেঞ্জারে, তারপর হোয়াটসঅ্যাপ কথা হয়। এরপর কয়েকবার কফি শপে দেখা করে কথাবার্তা হয়েছে। মননকে ভালোবেসে ফেলে নীল। মননের ভাবসাব দেখে নীলের মনে হতো, সেও হয়তো মনে মনে তাঁকে পছন্দ করে। একদিন সাহস করে মননকে মনের কথা জানিয়ে দেয় নীল।

সেই মেসেজ ‘সিন’ হয়েছিল। কিন্তু কোনো জবাব আসেনি। এর পর থেকে নীলের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয় মনন। মেসেজের উত্তর দেওয়া দূরে থাক, সিনও করত না। ফোনও ধরত না। মননের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ওদিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এরপর মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়ে নীল। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ, সময় কাটানো, আড্ডা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। পুরোপুরি অফিসে মন দেয়। ‘মার্চেন্ডাইজার’ হিসেবে সে দৈনিক ১২ ঘণ্টা করে অফিস করে। বাবা, মা বা ভাই ফোন করলেও তার কথা বলতে ইচ্ছা করে না।

সম্প্রতি নীলের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। জানা গেল, মননের ঘটনার পর দুই থেকে তিনজন মেয়ের সঙ্গে তার অনলাইনে যোগাযোগ হয়েছে। কয়েক দিন কথা হয়েছে। তবে তারা সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আগ্রহী হলেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে নীল। কথাবার্তা আর এগোয়নি। অফিসে তার পদোন্নতি হয়েছে। তবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক জীবন বলে তার আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। এই মুহূর্তে নতুন করে আর কোনো সম্পর্কে জড়ানোর বা বিয়ের কোনো ইচ্ছাই তার নেই।

অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘বাজ ফিড’ গোস্টিংয়ের শিকার এমন ১৫ জনের মানসিক অবস্থা নিয়ে কেস স্টাডি প্রকাশ করে। কী ধরনের মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে তাঁরা গিয়েছেন, সেই অভিজ্ঞতা লিখে পাঠিয়েছেন গোস্টিংয়ের শিকার ভুক্তভোগীরা। সেগুলোর ভেতর থেকে ১৫টি প্রকাশিত হয়েছে। এর ভেতর একটি কেস স্টাডি নীলের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। আর এই মানসিক অবস্থা বিষয়ে সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও থেরাপিস্ট এলিজাবেথ আর্নশ জানান, এটা একধরনের সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার। যেখানে ‘ভিকটিম’ নিজেই ‘অপরাধী’র জায়গা নেন আর নিজেকে ‘ক্ষমতাবান’ (এম্পাওয়ার্ড) মনে করেন। মানসিকভাবে একটা ‘অসুস্থ্ আত্মতৃপ্তি’তে ভোগেন!

হঠাৎই যে জেন-জিদের সম্পর্কের সংস্কৃতিতে ‘গোস্টিং’এসে হাজির হলো, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। শুরু থেকেই সম্পর্কে এ ধরনের পরিস্থিতি ছিল। এক দশক ধরে এমন পরিস্থিতির নাম দেওয়া হয়েছে ‘গোস্টিং’। কয়েক দশকে এমন সব ঘটনা সামনে আসায় গবেষণায় গুরুত্ব পাচ্ছে গোস্টিং। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত দশ বছরে সম্পর্কবিষয়ক থেরাপিস্টদের কাছে যত মানুষ পেশাদার সাহায্যের জন্য গিয়েছেন, তাঁদের শতকরা ৩০ ভাগই কোনো না কোনোভাবে গোস্টিংয়ের শিকার। সময়ের সঙ্গে এটি আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ যত সহজ হয়েছে, ব্লক করার মাধ্যমে গোস্টিং করাও ততটাই সহজ হয়েছে।

‘বাজ ফিড’-এ নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন গোস্টিংয়ের শিকার ৪৪ বছর বয়সী জেনি। অনলাইন ডেটিং অ্যাপ বাম্বলের মাধ্যমে ভিনদেশের একজনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন তিনি। লোকটি জেনির প্রতি খুবই আগ্রহ দেখান। দুজনেই তাঁদের অনুভূতির কথা জানান। লোকটির সঙ্গে কয়েকবার দেখাও করেন জেনি। এ রকমই একবার নিজের জন্মদিনে লোকটির সঙ্গে দেখা করতে উড়াল দেন তাঁর দেশে।

বিমানবন্দরে নেমে লোকটির ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সবখানেই জেনিকে সে ব্লক করে দিয়েছে। ওই মানুষটির বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জেনি। জানতে পারে, লোকটি বিবাহিত নন বা অন্য কোনো সম্পর্কেও জড়াননি। কিন্তু তিনি জেনির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আর সেটা সরাসরি জানানোর ‘সাহস’ পাননি।


প্রায় দুই সপ্তাহ শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন জেনি। নিজের ওপর থেকে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন। ভাবছিলেন, হয়তো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য তিনি নন। কারও জীবনসঙ্গী হওয়ার যোগ্য নন। এরপর তিনি থেরাপিস্টের সাহায্য নেন। ৯ মাস ধরে চলেছে সেই সেশন। নিজের শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেন। ফিটনেস, স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুমের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। পরিবারের সঙ্গে আরও বেশি করে সময় কাটান। ৯ মাস পর মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ আর ভারমুক্ত বোধ করেন। তাঁর মতো অবস্থায় পড়ে নারীরা যাতে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা পান সে জন্য একটি মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলেন। জেনি আর তাঁর নতুন সঙ্গী এখন তাঁদের স্বাস্থ্যকেন্দ্র দেখাশোনা করেন। তাঁরা ভালো আছেন। জেনি বলেন, ‘আমি আসলে লোকটাকে ধন্যবাদ দিতে চাই। হয়তো ওই ঘটনা না ঘটলে এভাবে আমার জীবনের মোড় ঘুরে যেত না। ওই লোকের সঙ্গে থাকলে কখনোই আমি এতটা ভালো থাকতাম না। আমি মেনে নিয়েছি। ঘুরে দাঁড়িয়েছি। নিজেকে আর কক্ষনো দোষারোপ করিনি।’

‘মেন’স হেলথ’-এর একটি প্রতিবেদনে গোস্টিংয়ের শিকার ব্যক্তিরা কী ধরনের মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যান, তা বলা হয়েছে—


১. যাঁর মাধ্যমে ‘গোস্টিং’য়ের শিকার হয়েছেন, প্রাথমিকভাবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘কারণ জানা’র জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন তাঁরা। লম্বা লম্বা বার্তা পাঠান। তাঁর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। এই সব কারণে পরে আরও বেশি করে সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করেন, লজ্জিত হন, ‘আত্মমর্যাদা’ হারান।

২. গোস্টিংয়ের শিকারদের অনেকে শুরুতে নিজেকে দায়ী করেন। কবে কী বলেছেন, কী করেছেন—এই কারণে অপর পক্ষের ‘মন উঠে গেছে’, এভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পুরো দায় নিজের ঘাড়ে চাপান।


৩. অনেকে আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগেন। এমনটাও মনে হতে থাকে যে তিনি আসলে ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নন।


৪. এই আত্মবিশ্বাসের অভাব পরে অনেকের ব্যক্তিজীবন, ব্যক্তিগত অন্যান্য সম্পর্ক, পড়াশোনা, চাকরি, সামাজিক জীবন থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।


৫. অনেক সময় গোস্টিংয়ের শিকার ব্যক্তি অন্য কোনো সম্পর্কে জড়ানোর সাহস, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। সম্পর্কে ভরসা পান না। অন্যকে বিশ্বাস করতে পারেন না।


৬. আত্মহত্যার প্রবণতা পর্যন্ত দেখা যেতে পারে।


৭. কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, গোস্টিংয়ের শিকার হওয়া ব্যক্তি সুযোগ পেলে নিজেও গোস্টিং করেন। এভাবে একটা ‘দুষ্টচক্র’ তৈরি হয়।


৮. এককথায়, গোস্টিংয়ের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা প্রাথমিকভাবে ও দীর্ঘ মেয়াদে মারাত্মক ও জটিল মানসিক বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে যান।


আসলে সম্পর্কে গোস্টিংয়ের মতো কাপুরুষোচিত আচরণ খুব কমই হয়! কোনো যুক্তিতেই গোস্টিংকে বৈধতা দেওয়া যায় না।

Photo by Engin Akyur from pexels