বিরক্ত হয়ে বাবার দিকে তাকালাম। সকাল থেকে এই এক কথা ১০০ বার জিজ্ঞেস করে ফেলেছেন, ‘কাল যা নাহয়? একদম ভোরে বাসে তুলে দিই?’
না তাকিয়েই জবাব দিলাম, ‘ক্লাস মিস হয়ে যাবে।’
বাবা উৎফুল্ল গলায় বলল, ‘আরে ধুর ব্যাটা, একটা–দুইটা ক্লাস মিস হলে এমন কী ক্ষতি। ব্যাগটা এদিকে দে তো। বাকি জিনিস রাতের বেলা সময় করে গুছিয়ে দেব।’ বাবা আমার ব্যাগের দিকে হাত বাড়ালেন।
আমি রাগ করে বললাম, ‘দেখো বাবা, প্রতিবার তুমি এ রকম করো।’
বাবা ব্যাগ ছেড়ে দিলেন। বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘কী হতো আর একটা দিন থাকলে? আমরা কী লেখাপড়া করিনি?’
পাত্তা দিলাম না। আরও দুই দিন আগেই যাওয়া উচিত ছিল। ‘কাল যা’, ‘আজ এই ঝামেলা’, ‘ওই ঝামেলা’ শুনতে শুনতে দুই দিন থাকতে হলো।
‘সবকিছু ঠিকঠাক করে নিয়েছিস তো? নারকেলের গুঁড়ি কিন্তু বড় ব্যাগটায় দিয়েছি। ব্যাকপ্যাকে বিস্কুট দিয়েছি। ব্যাগের পাশেই পানি আর কোক। রাস্তায় ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নিবি। আর বড় ব্যাগে শুঁটকি, মাংস আর শিং মাছের তরকারি রেখেছি। গিয়েই এগুলো ফ্রিজে ঢোকাবি। মানিব্যাগে টাকা রেখেছি কিছু। দেখ তো আরও লাগবে কি না,’ বাবা বলে চলেন।
আমি মানিব্যাগ বের করলাম না। খুব ভালো করেই জানি, যে পরিমাণ টাকা আছে, তা যথেষ্ট। কেবল ছোট করে বললাম, ‘লাগবে না আর।’
রিকশায় করে বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার সময় বাবা মুখস্থ হয়ে যাওয়া উপদেশগুলো দিতে শুরু করল, ‘ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করবি। বাইরের কিচ্ছু খাবি না। আপেল, কমলা কিনে আনবি। পানি খাবি বেশি করে। নামাজ পড়বি। ঠিক সময়ে ঘুমাবি। রাত জাগবি না খবরদার।’
হেসে ফেললাম, ‘কুলারের পানি খেতে নিষেধ করতে ভুলে গেছ, বাবা!’
বাবার মুখে লাজুক হাসি। বাস ছেড়ে দেবে। নেমে পড়ার আগে হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিল বাবা, ‘বাসে কিছু খেতে ইচ্ছা করলে কিনিস!’ এই তিন বছরে বাবাকে এটা বোঝাতে পারলাম না যে এটা ডাইরেক্ট বাস। কোথাও থামে না। বাসে কিছু খেতে ইচ্ছা করলেই কীভাবে খাব?
বাস চলতে শুরু করেছে। গতি বাড়ছে আস্তে আস্তে। তাকাব না তাকাব না করেও বাস থেকে মাথাটা একটু বের করলাম। ছোট হতে থাকা কাঠামোটা মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। এই তো! বাঁ হাত দিয়ে চোখটা মুছল! এত ছেলে মানুষ কেন আমার বাবা?