ঈশান আমুদে প্রকৃতির মানুষ। আড্ডা মাতিয়ে রাখতে তার জুড়ি মেলা ভার, ফলে যেখানেই কোনো উৎসব-আয়োজন, সেখানেই ঈশানের ডাক পড়ে। তবে এই প্রাণচঞ্চল স্বভাবের জন্যই কিনা কে জানে, পড়াশোনায় তার তেমন মন নেই। বন্ধুরা নিজেদের প্রয়োজনে তাকে দলে রাখলেও তার প্রয়োজনে এগিয়ে আসে না, আড়ালে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। একাডেমিক কার্যক্রমে কেউ তাকে গ্রুপে নিতে চায় না। বন্ধুত্বের যা কিছু দায়দায়িত্ব সব যেন ঈশানেরই পক্ষ থেকেই পালনীয়, অপর পক্ষের কোনো দায় নেই।
যারা এমনটা করে তাদের কি আদতে বন্ধু বলা যায়? বন্ধু নামধারী এসব অবন্ধুর পাল্লায় পড়ে শারীরিক ও মানসিক—দুই দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হই আমরা। বিষাক্ত সম্পর্কের পাকে পড়ে জীবনে নেমে আসে বিষাদ। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট গিলিয়ান নিডেলম্যানের মতে, বন্ধুত্বের তিক্ত সম্পর্কগুলোর রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ব্যক্তির মধ্যে সৃষ্টি হয় হীনম্মন্যতা। নিজের সামর্থ্য বিষয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে ব্যক্তি। এমনকি ব্যক্তি নিমজ্জিত হতে পারে অন্তহীন হতাশায়। তাই এসব ‘বন্ধুর’ সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে।
একটি সুস্থ জীবনের জন্য যেসব বন্ধুকে এড়িয়ে চলতে হবে—
বন্ধু, না শত্রু
ভাবুন তো, আপনার কোনো সাফল্যে আপনারই কোনো বন্ধু মজার ছলে মৌখিক আক্রমণ করেছে কি না? অথবা আপনার কাজের সমালোচনা করতে গিয়ে বন্ধুমহলে কারও কারও সত্যবচন কি বাকিদের তুলনায় একটু বেশি রূঢ় শুনিয়েছিল? এ ধরনের বন্ধুদের চিহ্নিত করতে রয়েছে একটা বিশেষ নাম—ফ্রেনেমি। মার্কিন কলামিস্ট ওয়াল্টার উইনচেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শব্দটি ব্যবহার করেন। ফ্রেন্ড ও এনেমির মিশেলে তৈরি করা হয়েছিল শব্দটা। শুধু আন্তর্জাতিক অঙ্গনেই নয়, আমাদের জীবনেও আমরা অহরহ এমন ফ্রেনেমিদের সঙ্গে চলাফেরা করি। মেরিয়াম ওয়েবস্টার ডিকশনারি অনুযায়ী, ফ্রেনেমিজ হলো সেসব ব্যক্তি, যারা আপনার সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করলেও আদতে আপনাকে শত্রু ভাবে। জীবনে বন্ধুর প্রয়োজন থাকলেও ছদ্মবেশী ফ্রেনেমিদের প্রয়োজন নেই। এদের এড়িয়ে চলুন।
কথা দিয়েও যারা কথা রাখে না
একটি কথা বেশ চালু আছে, বন্ধুত্বের সম্পর্ক আজীবন টিকে থাকে। কিন্তু আসলেই কি কিছু মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক? স্ট্যামফোর্ডের ইউনিভার্সিটি অব কানেটিকাটের সমাজবিজ্ঞানী জেন ইয়াগারের মতে, ‘কিছু সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়াই ভালো, বিশেষ করে তা যখন ব্যক্তির মানসিক শান্তির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।’ জেন ইয়াগার তাঁর হোয়েন ফ্রেন্ডশিপ হার্টস বইতে ২১ ধরনের খারাপ বন্ধুদের নিয়ে আলোচনা করেছেন, যার মধ্যে বহুল পরিচিত হলো প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারী। আপনাকে কেউ কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে রক্ষা না করলে এবং তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ কাজ না করলে ধরে নিতে হবে সে আপনাকে অসম্মান করছে। শুধু অসম্মানই করছে না, বরং এটা প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে যে আপনার কোনো মূল্যই তার কাছে নেই! সুতরাং নিজের ভালো চাইলে এসব বন্ধুকে ছাড়ুন।
যে শুধু নিজেরে ভালোবাসে
ধরুন, আপনারা কয়েক বন্ধু মিলে কোথাও ঘুরতে গেছেন। আপনার বন্ধুভাগ্য মন্দ হলে এই দলের মাঝেই খুঁজে পাবেন এমন একাধিক ব্যক্তি, যারা নিজের পছন্দ অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে ওস্তাদ। হোক সেটা ভ্রমণের জায়গা বাছাই কিংবা রেস্তোরাঁয় খাবার নির্বাচন। এসব বন্ধু এমনই আত্মমগ্ন থাকে যে অন্যের সুবিধা-অসুবিধাকে বিবেচনায় রাখতে চায় না। এসব বন্ধুর কাছ থেকে সাবধান!
বন্ধুত্বেও যারা প্রতিযোগিতা খোঁজে
মনে আছে ছোটবেলার সে স্মৃতি? আপনার বন্ধু কেন আপনার থেকে ২ নম্বর বেশি পেল, তা নিয়ে বাবা-মার কত শোরগোল। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আপনার জীবনে আপনি এমন কিছু বন্ধুকে পাবেন, যারা সব ক্ষেত্রেই আপনার সঙ্গে অসুস্থ প্রতিযোগিতা করতে চাইবে। এই বন্ধুদের শুরুতেই চিনতে না পারলে তারা আপনার শিক্ষাজীবন কর্মজীবন ছাপিয়ে পারিবারিক জীবনেও পিছু নেবে। মনে রাখবেন, সত্যিকার বন্ধু কখনোই আপনার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হবে না। আপনার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে চাইবে না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুযোগসন্ধানী বন্ধু
ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে কারও সঙ্গে পরিচিত হতে আজকাল আর বেশি সময় লাগে না। কয়েক দিনের আলাপচারিতায় এসব স্বল্প পরিচিত মানুষকে যদি বন্ধু ভেবে বসেন, তবেই বিপত্তি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে যে বন্ধু পাওয়া যায় না, এমন না। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বন্ধুত্বের যে সংজ্ঞা রয়েছে, তা এসব সামাজিক বন্ধুদের ক্ষেত্রে খাটে না। তাই এমন ঘটনা অহরহ ঘটতে দেখা যায় যে অপরপক্ষের আকুল আবেদনে সাড়া দিয়ে আর্থিক সহায়তা করার কয়েক দিনের মধ্যেই ব্যক্তিটির স্থান হয় ব্লক লিস্টে। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধু নির্বাচনে সাবধানী হতে হবে।
তথ্যসূত্র: টেলিগ্রাফ