মনিরার (ছদ্মনাম) বয়স ৩৮ বছর আর সাইদের (ছদ্মনাম) ৪১। তাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় ১৫ বছর। দুটি সন্তানও আছে। হঠাৎ জানা গেল, তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। স্বজন, বন্ধু, পরিচিত সবারই প্রশ্ন—‘বিয়ের এত বছর পরে কেন হঠাৎ ডিভোর্স?’
মনে রাখতে হবে, বিচ্ছেদ একটি বৈধ প্রক্রিয়া। আইনসম্মতভাবে যেকোনো দম্পতি যেকোনো বয়সেই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। বিচ্ছেদ নিয়ে ট্যাবু আছে। আছে নানা জাজমেন্টাল মন্তব্য। বিচ্ছেদ উৎসাহিত করার মতো কোনো বিষয় নয়, কিন্তু কখনো কখনো বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতেই হয়। মনিরা আর সাইদের জীবনেও এমনটা ঘটেছিল। তাদের জীবনে তৃতীয় ব্যক্তির অনুপ্রবেশ তাদের সম্পর্ককে এত নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছিল যে ব্যাহত হচ্ছিল সন্তানদের বিকাশ। পারিবারিক অশান্তি দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল। অনেক চেষ্টার পরেও দাম্পত্য সম্পর্কের জায়গাটি ঠিক না হওয়ায় বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন তারা।
২০২৩ সালের জুনে প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে কেবল ঢাকা মহানগরীতে তালাকের আবেদন পড়ে ১৩ হাজার ২৮৮টি। নোটিশ দেওয়ার পর আপস হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। এ হিসাবে রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩৭টি দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে অর্থাৎ প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি করে তালাকের ঘটনা ঘটছে! প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিচ্ছেদ আবেদনের ৭০ শতাংশই করেছেন নারীরা।
২০২৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) আরেক জরিপের তথ্য বলছে, দেশে বিয়ে আর বিচ্ছেদ—দুটির হারই বেড়েছে। তিন লাখের বেশি পরিবারে এই জরিপটি চালায় বিবিএস। তাদের হিসাবে, ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল সময়ে মোট জনসংখ্যার অনুপাতে বিচ্ছেদের হার শূন্য দশমিক ৬ থেকে ১ দশমিক ১ শতাংশের মধ্যে ছিল। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ১ দশমিক ৪ শতাংশ। আবার ২০২১ সালে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে নারীদের সাধারণ বিবাহবিচ্ছেদের হার ছিল ২ শতাংশের সামান্য কম। সেটা পরের বছর বেড়ে হয় ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। একইভাবে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে পুরুষের ক্ষেত্রে হারটি ২০২১ সালে ছিল ২ শতাংশের সামান্য বেশি। পরের বছর তা বেড়ে হয় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। বিচ্ছেদের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক। ২০২০ সালে বাংলাদেশে প্রকাশিত আরেক গবেষণা নিবন্ধ (ইবিএইউবি জার্নাল অব ল, ভলিউম ২, ২০২০) অনুযায়ী, ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী নারী–পুরুষের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেশি। আর যাদের বাল্যবিবাহ হয়েছিল, তাদের মধ্যেও বিচ্ছেদের হার বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রপার্টি আইনবিষয়ক এক প্রতিবেদনমতে, ৫ বছর টেকা বিয়েকে বলা হয় স্বল্প মেয়াদি, ৫ থেকে ২০ বা ২৫ বছর পর্যন্ত মধ্যমেয়াদি আর ২০ বা ২৫ বছরের বেশি সময় টিকে থাকা বিয়েকে বলা হয় দীর্ঘমেয়াদি বিয়ে। আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ঘণ্টায় ৮৬টি বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। সেখানে প্রতি ৪২ সেকেন্ডে ১টি করে বিচ্ছেদ হয়। আর সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদ হয় বিয়ের আট বছরের কাছাকাছি সময়ে।
সাইকোলজি টুডে জার্নালে ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ অনুযায়ী, যিনি একবার বিবাহবিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যান, তার মধ্যে পুনর্বার বিচ্ছেদ হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। পশ্চিমা বিশ্বে ‘গ্রে ডিভোর্স’ (৫০ বছর বয়স হওয়ার পর বিচ্ছেদ)–এর হার বাড়ছে, কিন্তু এরপরও তা ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে হওয়া বিচ্ছেদের চেয়ে কম। তাতে এ কথা বলা যায়, বিয়ে–পরবর্তী দাম্পত্য জীবন যত দীর্ঘ হয়, বিচ্ছেদ হওয়ার প্রবণতা তত কমতে থাকে। এরপরও কখনো কখনো বিচ্ছেদ হয়েই যায়। সাইকোলজি টুডের তথ্য অনুযায়ী, দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে যত বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে, তার বেশির ভাগই দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়েতে হয়ে থাকে। গবেষণা বলছে, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য বিচ্ছেদ না হওয়ার ক্ষেত্রে (বিয়ে টিকিয়ে রাখার পক্ষে) একটা বড় নিয়ামক। অনেকে বিয়ের অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই মনে মনে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু ভাবেন, সন্তানদের একটু বড় করে বিচ্ছেদে যাবেন। তবে মা-বাবার বিচ্ছেদ যখনই হোক না কেন, সন্তানের বয়স তখন যতই হোক, সেটা তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একেক বয়সে হয়তো একেক রকম প্রভাব পড়ে, কিন্তু সবই নেতিবাচক। আর দীর্ঘ দাম্পত্যের পরে বিচ্ছেদ ডেকে আনতে পারে দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্নতা। তবে এই ‘গ্রে ডিভোর্স’ কারও কারও জন্য মানসিক চাপ কমানোর উপায়ও বটে। অনেকে দীর্ঘমেয়াদি যন্ত্রণা, নির্যাতন থেকে মুক্তি দেয় এই বিচ্ছেদ। তবে মনে রাখতে হবে, এই গবেষণালব্ধ সব তথ্যই পশ্চিমা সমাজের, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে এই গবেষণার সব তথ্য মিলবে না।
দীর্ঘ দাম্পত্যের পর যেসব কারণে হতে পারে বিচ্ছেদ—
বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক
পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব
পারিবারিক সহিংসতা
যৌনজীবনে অপূর্ণতা
দারিদ্র্য ও টানাপোড়েন
সন্তানের কোনো সমস্যা নিয়ে মতানৈক্য
মানসিক রোগ (ব্যক্তিত্বের সমস্যা, মাদকাসক্তি)
বাল্যবিবাহ
জীবনে ঘটে যাওয়া বড় কোনো দুর্ঘটনা, বিপর্যয় ইত্যাদি
যে কারণেই হোক, দীর্ঘ দাম্পত্যের পর বিচ্ছেদ হলে যে বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে—
আবেগ নিয়ন্ত্রণ করুন। মনের স্বাস্থ্যের যত্ন নিন। মানসিক সংকটে প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
শোক, দুঃখ বা আঘাতকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।
আর্থিক ব্যবস্থাপনা বা সম্পত্তির বিষয়ে আইন ও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাবেন না। কাউকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করবেন না।
নিজেকে গুটিয়ে রাখবেন না। নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখুন। নতুন করে নিজেকে পরিচিত করান।
পেশাগত আর সামাজিক কর্মকাণ্ডে সাবলীল থাকুন। মনে রাখবেন, বিচ্ছেদ একটি বৈধ প্রক্রিয়া।
সন্তানের বিষয়ে আইনি ও নৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখুন। বিচ্ছেদ হয় স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে, মা–বাবা ও সন্তানদের মধ্যে নয়। ফলে প্রাপ্য স্নেহ–ভালোবাসা থেকে সন্তানকে বঞ্চিত করবেন না।
নতুন কোনো সম্পর্ককে ভবিষ্যতে বিয়েতে রূপান্তর করবেন কি না, সার্বিকভাবে সেটি বিবেচনা করুন। বিষয়টি নিয়ে সন্তানের সঙ্গে তো বটেই, সম্ভব হলে আপনার প্রাক্তনের সঙ্গেও আলোচনা করুন।
লম্বা দাম্পত্যের পর বিচ্ছেদ হলেও এটাকে একটি নতুন শুরু হিসেবে দেখুন।
চারপাশের যাদের সঙ্গ আপনার ভালো লাগে, তাদের সঙ্গে সময় কাটান।