শিশুর প্রশ্ন যখন অস্বস্তির কারণ

সন্তানের সব প্রশ্নেরই যুক্তিযুক্ত উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন।
ছবি : অধুনা

মায়ের সঙ্গে স্কুলে যাবে ধ্রুব। লিফট দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ সাত বছরের ধ্রুব তার মায়ের কাছে জানতে চায়, বড় মেয়েরা ডায়াপার পরে কেন? হঠাৎ ছেলের মুখে এ প্রশ্ন শুনে মা কী বলবেন বুঝতে না পেরে জানতে চান, সে কীভাবে বুঝল এটা মেয়েদের ডায়াপার? জবাবে ধ্রুব জানায়, টেলিভিশনে কার্টুনের মাঝখানে বিজ্ঞাপনে সে দেখেছে যে বড় মেয়েরা ডায়াপার পরে। মা কী উত্তর দেবেন বুঝতে না পেরে বললেন, একটু বড় হলে সব মেয়েকেই এটা পরতে হয়। তুমি বড় হলে বিষয়টা পরিষ্কার বুঝতে পারবে। তখন ধ্রুব পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘তার মানে তুমিও পরো?’

ধ্রুবর মা আফিয়া যথেষ্ট সচেতন। ছেলের সব প্রশ্নেরই যুক্তিযুক্ত উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন। অন্তত তাকে ভুল কিছু শেখাতে চান না। কিন্তু এটুকু ছেলের এমন সব প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দেবেন, তা ভেবে পান না

কেবল আফিয়া নন, আজকাল অনেক মা-বাবাই সন্তানের জিজ্ঞাসু মনের সঙ্গে পেরে ওঠেন না। হঠাৎ করেই হয়তো তারা এমন সব প্রশ্ন করে বসে, যেটার উত্তর সহজ কথায় সব সময় দেওয়া যায় না। বিশেষ করে ঋতুস্রাব, সন্তান ধারণ বা জন্মদানের মতো প্রসঙ্গে, যেগুলো নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যেই একধরনের অস্বস্তি কাজ করে। প্রাথমিক পরিচর্যাকারী (প্রাইমারি কেয়ারগিভার) হিসেবে মা সাধারণত মেয়েশিশুর কৌতূহল সম্পর্কে কিছুটা বুঝতে পারেন বা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন। কিন্তু বিপাকে পড়েন ছেলেশিশুর মায়েরা। তাঁরা সন্তানকে বিভ্রান্ত করতে চান না, আবার নিজের অস্বস্তি কাটিয়ে কীভাবে কৌতূহল মেটাবেন, সেটাও বুঝতে পারেন না।স্যানিটারি

এসব ক্ষেত্রে ছেলেশিশুর মা-বাবা কীভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন, সে সম্পর্কে জানতে চাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসারের কাছে।

কোন বয়স থেকে শিশুর মনে এসব প্রশ্ন জন্ম নেয়?

নির্দিষ্ট করে বয়স বলা যায় না। নিজের দেখা-শোনার ভিত্তিতে তিন বছরের শিশু এমন প্রশ্ন করতে পারে। আবার ১৮ বছর পর্যন্তও অনেকের মাথায় এসব প্রশ্ন না-ও আসতে পারে।

এ ক্ষেত্রে শিশুকে কি মনগড়া উত্তর দেওয়া যাবে? নাকি বুঝিয়ে বলতে হবে?

মনগড়া উত্তর দেওয়া যাবে না ঠিকই, কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে যে সে এখনই সব বুঝতে পারবে না। তাই বয়স অনুযায়ী যতটুকু বুঝিয়ে বলা সম্ভব, বলতে হবে। সাত বছরের শিশু যখন স্যানিটারি ন্যাপকিন সম্পর্কে জানতে চাইছে, তখন তাকে বলা যেতে পারে যে এটা মেয়েরা ব্যবহার করে। তবে আরেকটু বড় হলে তখন সে বিষয়টা বুঝতে পারবে। ফলে কিছুদিন পর যখন সে বড় হবে, তখন তাকে বুঝিয়ে বলা হবে।

অনেকেই সন্তানের কাছে এসব বিষয় লুকিয়ে রাখেন। এটা কি ঠিক?

দেখুন, লুকিয়ে রাখার যে সংস্কৃতি, এটা তো এক দিনে তৈরি হয়নি। হাজার বছর ধরে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি এসব লুকিয়ে রেখেছে। ফলে এক দিনে হুট করে সত্যি কথাটা বলে দিলে সেটার ফল যে খুব ভালো হবে, এমনটা আশা করা যায় না। শিশু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে, সে অনুযায়ী তাকে সেগুলোর উত্তর বুঝিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ শিশু তার বয়সের, বড় হওয়ার একেকটা স্তরে গিয়ে একেক আচরণ করবে। তখন মা–বাবা কিংবা অভিভাবককে তাদের মতো করে সত্যটা বুঝিয়ে বলতে হবে।

অনেক সময় বন্ধুদের কাছ থেকে ভুলটা শেখে। সে ক্ষেত্রে তাকে কি এটা বলা হবে যে এসব প্রশ্নের উত্তর কেবল মা-বাবার কাছ থেকে জানবে?

অবশ্যই না। আপনি ওর জানার দরজা বন্ধ করে দিতে পারেন না। ও জানুক, শিখুক। যতক্ষণ পর্যন্ত ভুল জানায় ওর বা অন্য কারও ক্ষতি না হচ্ছে, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। যখন মা–বাবা দেখবেন যে শিশু ভুল কিছু শিখছে, তখন তারা সেটা শুধরে দেবেন।

বর্তমানে শিশুরা ছেলেমেয়েদের শরীর বা সন্তান ধারণ সম্পর্কে এমন সব প্রশ্ন করে যে মা–বাবারা হকচকিয়ে যান। তাঁরা ভাবেন, এই বয়সে এমন প্রশ্ন! এর কারণ কী?

আগে খেলার মাঠ ছিল, অনেক রকম কর্মকাণ্ড ছিল। ছেলে–মেয়েরা একসঙ্গে খেলাধুলা করে বড় হতো। কিন্তু এখন সে সুযোগ পায় না। বরং তাদের সামনে ইন্টারনেটের বিরাট দুনিয়া খুলে গেছে। তারা টেলিভিশন দেখে, ইউটিউব দেখে বড় হয়। ফলে তাদের মনে অনেক ধরনের প্রশ্ন তৈরি হয়, কৌতূহল তৈরি হয়। সেখান থেকেই এসব প্রশ্ন করে। জানার আগ্রহ তৈরি হয় বলেই করে। তাদের বলতে হবে, শিশুর জন্মের জন্য মা–বাবা দুজনের প্রয়োজন হয়। তারা মায়ের পেট থেকে জন্ম নেয় ঠিকই, কিন্তু বাবা না থাকলে তারা জন্ম নিতে পারত না।

ছেলেশিশুর মা–বাবাদের জন্য বিশেষ কোনো পরামর্শ দেবেন কি?

ছেলে বা মেয়ে বলে নয়, সব শিশুর মা–বাবাদের বলতে চাই। শিশুকে প্রকৃতির নিয়মে বড় হতে দিন। কোনো নির্দিষ্ট বিষয় চাপিয়ে, জোর করে শিখিয়ে নয়; সে বয়স বা সময়ের সঙ্গে যেসব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাবে, সে অনুযায়ী তাকে প্রশ্ন করতে দিতে হবে। যখন যে প্রশ্ন আসবে, তার বয়স এবং মা–বাবার বিবেচনা অনুযায়ী সেটির উত্তর বুঝিয়ে বলতে হবে। মনে রাখতে হবে যে প্রতিটি শিশু আলাদা। প্রতিটি পরিবার আলাদা। ফলে এক পরিবার যে নিয়ম মেনে শিশু পালন করছে, আরেকটি পরিবারও সেভাবে সফল হবে, এমনটা বলা যাবে না। এমনকি আমরা প্যারেন্টিংয়ের যে বিভিন্ন স্কুলিংয়ের কথা বলি, সেগুলোও কিন্তু একেকটি পদ্ধতি। পাশ্চাত্যের পদ্ধতি যে আমাদের দেশের সব পরিবারের জন্য উপযোগী হবে, সেটা কিন্তু নয়।