‘আমার মা কি খুব ঝগড়াটে? তোমাকে জ্বালাতন করত?’
শিহাবকে (ছদ্মনাম) অবাক করে দিয়ে এ প্রশ্ন করেছিল তার ৮ বছর বয়সী মেয়ে রিমি (ছদ্মনাম)।
‘না তো। তোমার মা খুব ভালো একজন মানুষ...খুবই ভালো,’ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল শিহাব।
‘তাহলে তোমাদের ডিভোর্স হলো কেন?’
ভ্যাবাচেকা খেয়ে রিমির মুখের দিকে নির্বাক তাকিয়ে ছিল শিহাব। তাৎক্ষণিক মুখে আর কোনো বোল ফোটেনি।
রিমিকে আজ দেখতে যাওয়ার দিন। বাইরে খুব বৃষ্টি। কিন্তু ঝড়-বাদল যত যা–ই হোক, শিহাবকে কি আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে! সপ্তাহের এই একটা দিনই তো মেয়েটাকে দেখার সুযোগ। নিজেরই মেয়ে, তবু কাছে রাখার অধিকার নেই। আদালতই ঠিক করে দিয়েছে, মেয়ে থাকবে মায়ের কাছে, সপ্তাহে শুধু এক দিন সে মেয়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবে।
শারমিনের (ছদ্মনাম) সঙ্গে আইনি বিচ্ছেদ হয়েছে প্রায় দুই বছর। আবার বিয়েও করেছে শারমিন, শিহাব অবশ্য এখনো একাই আছে। শারমিন আর তার স্বামী দুজনই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি করে। শনিবার তাদের অফিস খোলা। ব্যাংক কর্মকর্তা শিহাবের ছুটি শনিবার, রিমিরও এদিন স্কুল বন্ধ। এই একটা দিনের জন্য সপ্তাহভরই অপেক্ষা করে বাবা-মেয়ে। কোনো দিন রিমি আসে তার বাসায়, শারমিন বা তার স্বামী আজাদ নামিয়ে দিয়ে যায়; কোনো দিন শিহাব নিজেই গিয়ে হাজির হয় শারমিনের বাসায়। দিনের আধা বেলা কাটিয়ে আনন্দ আর হাহাকারের এক অদ্ভুত অনুভূতি ফিরে আসে।
কিন্তু গত সপ্তাহে রিমির প্রশ্নটা তাকে গভীর ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। মেয়ের মাথায় কেন এল এই প্রশ্ন? তখনকার মতো একটা উত্তর না হয় দেওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ‘কেন তোমরা আলাদা হয়ে গেলে?’ প্রশ্নের তো কোনো উত্তর দিতে পারেনি। হয়তো নিজেও সে উত্তরটা জানে না । কী দোষ ছিল শারমিনের? সে খুব অধিকারপপ্রবণ ছিল, খুব কর্তৃত্বপরায়ণ ছিল। কিন্তু এগুলোকে কি খুব বড় অপরাধ হিসেবে ধরে নেওয়া যাবে? নিজের স্বামীকে অন্য কোনো নারীর সামান্য ঘনিষ্ঠ হতে দেখলেই সহ্য করতে না পারা, অহেতুক সন্দেহ বা তাকে একটু নিজের পছন্দমতো চালানোর চেষ্টা—এসব কতটা অপরাধ? প্রথমটা একধরনের নিরাপত্তাহীনতা, দ্বিতীয়টা অধিকারবোধ। এ দুটোই তো জন্ম নেয় স্বামীর প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকে। সেই ভালোবাসার চাপটা নিতে পারল না শিহাব। তার নিজেরও কি দোষ নেই? চিরকালই দায়দায়িত্ব বোধটা কম, স্ত্রী-সন্তানকে সময় দিতে না পারা, তাসের আসরে আসক্ত হয়ে পড়া, সামান্যতেই বেশি রেগে যাওয়া, মুখে যা আসে বলে ফেলা...ইত্যাদি।
নিজেদের সমস্যা নিয়ে একবার মনোরোগ চিকিত্সকের কাছেও গিয়েছিল শিহাব–শারমিন। সব শুনে হেসে ফেলেছিলেন ডাক্তার, ‘আরে এগুলো কোনো সমস্যাই না। আমার সংসারে আপনাদের চেয়ে এসব ঝামেলা অনেক বেশি। আমাদের সংসার যখন দিব্যি টিকে আছে, আপনাদেরটাও এই ঝগড়াঝাঁটি মন খারাপ নিয়েই টিকে যাবে।’
কিন্তু টিকল না। রিমিকে যে বলেছিল, তোমার মা অনেক ভালো; এ কথাটা মন থেকেই বলেছে শিহাব। অভিমান কিছুটা আছে বটে, কিন্তু সত্যিই সে মনে করে শারমিন মানুষ হিসেবে ভালো, তার নিজেরই বরং সমস্যা বেশি। নইলে আজাদের সঙ্গে শারমিন চমত্কার সংসারজীবন চালিয়ে যাচ্ছে কী করে?
শিহাবের এখনকার মনোভাবটা তো জানলাম। কিন্তু তার সম্পর্কে শারমিনের মূল্যায়নটা আমরা জানি না। তবে এটা বুঝি ‘প্রাক্তন’ মানেই যে ‘প্রতিপক্ষ’ নয়; সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া মানেই যে চিরশত্রু হয়ে একের বিরুদ্ধে অন্যের বিষোদ্গার করতে থাকা নয়—এই কথাটা একবার বিশ্বাস করতে পারলে জীবনটা অনেক সুন্দর হয়ে ওঠে।
সম্পর্কচ্ছেদের পেছনে নিশ্চয়ই অনেক কারণ থাকে। অনেক অভিযোগ বা অভিমান জমা হয়ে অলঙ্ঘ্য দেয়াল গড়ে উঠলেই তো সম্পর্ক ভাঙে। কিন্তু নিজের সাবেক স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকার দোষত্রুটি সবার সামনে তুলে ধরতে থাকলে আদতে নিজের ক্ষুদ্রতাই প্রকাশ করা হয়। ভালো হয়, একটা সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখতে পারলে, আরও ভালো হয় ‘প্রাক্তন’ সম্পর্কে বরং দুটি ভালো কথা বলতে পারলে। এতে ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে, সমাজের কাছে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
কিছুদিন হলো অকালপ্রয়াত হলেন খ্যাতিমান সাংবাদিক ও সম্পাদক অমিত হাবিব। তাঁর এককালের সহধর্মিণী শবনম ফেরদৌসী অনলাইন পত্রিকা সারাবাংলা ডটনেটে প্রাক্তন স্বামীর যে স্মৃতিচারণাটি করেছেন, তা পড়ে অন৵ অনেক পাঠকের মতো এই লেখকও মুগ্ধ ও বিস্মিত। সম্পর্কচ্ছেদের পরও একটি মানুষকে কতটা নির্মোহভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, এই লেখা তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ যেন। শবনম ফেরদৌসী লিখেছেন, ‘জীবন আমাদের প্রেম কেড়ে নিলেও, দুজনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে একসঙ্গে। একটা ঘটনাবহুল সময় আমরা অতিক্রম করেছি এক ছাদের নিচে থেকে। এ দেশে প্রাক্তন মানেই প্রতিপক্ষ। বিচ্ছেদ মানেই শত্রু হয়ে যাওয়া। কিন্তু আমাদের ১৪ বছরের বিভাজিত সময়ে কেউ কারও শত্রু হইনি, বন্ধু হয়েও থাকিনি। চেষ্টা করেছি শ্রদ্ধা ও দূরত্ব বজায় রেখে চলতে। এমনকি এত বছর এক শহরে থেকেও আমাদের কোনো দিন আর কথা হয়নি, দেখাও নয়।’
যাঁরা প্রেম বা দাম্পত্য-সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর মারমুখী হয়ে ওঠেন, পরস্পরের চরিত্র হননের জন্য উঠেপড়ে লাগেন, তাঁরা শবনমের এই কটি লাইন মুখস্থ করে নিতে পারেন। জীবনকে অনেকটা নির্ভার মনে হবে। তবে এটাও তো ঠিক, দীর্ঘ ১৪ বছর অমিত হাবিবও তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী সম্পর্কে কোনো নিন্দামন্দ করেননি।
‘স্বর্গ হতে আসে প্রেম, স্বর্গে যায় চলে’— জাতীয় কথা আমরা হরদম শুনি বটে, বাস্তবের প্রেম কিন্তু সেভাবে আসে না। দুটি মানুষ প্রেম বা বিয়ের মাধ্যমে একসূত্রে নিজেদের বাঁধতে চেষ্টা করে। দুজনের পারিবারিক শিক্ষা, রুচি বা সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। তবু তারা যে কাছাকাছি থাকে, সংসার ও সন্তান নিয়ে সুখী হতে চায়, তার পেছনে থাকে ভালোবাসা। প্রেম ও ভালোবাসার প্রথম দিককার তীব্র আবেগ শেষ দিন পর্যন্ত হয়তো থাকে না। তবে এই সম্পর্ক ধীরে ধীরে মায়া-মমতা, নির্ভরতা ও সমঝোতার নানা ধাপ পেরিয়ে টিকে থাকে। চেষ্টা করতে হবে এই সম্পর্ক যাতে অটুট থাকে। কিন্তু নেহাত যদি না-ই থাকে, বন্ধু যদি না হতে পারি, শত্রু যেন না হই অন্তত। তখন দীর্ঘশ্বাসের সুরে নজরুলের সেই কবিতার পঙ্ক্তিটি উচ্চারণ করা যেতে পারে—‘তুমি মোরে ভুলিয়াছ তাই সত্য হোক/ সেদিন যে জ্বলেছিল দীপালি-আলোক/ তোমার দেউল জুড়ি—ভুল তাহা ভুল/ সেদিন ফুটিয়াছিল ভুল করে ফুল।’