মিথিলা আর সামদানির বিয়ে হয়েছিল রাজকীয়ভাবে। দুজনই ধনী পরিবারের একমাত্র সন্তান। সামদানির মা-ও একেবারে গয়না দিয়ে মুড়ে নিয়েছিলেন মিথিলাকে। বিয়েতে আসা প্রায় প্রতে৵ক অতিথিই ভেবেছিলেন, এমন স্বামী আর শ্বাশুড়ি পেয়েছেন, রাজকপাল মিথিলার!
দুই দিন না পেরোতেই মিথিলা শ্বশুরবাড়িতে কেমন অস্বস্তি বোধ করেন। নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে বালির ট্যুর প্ল্যান করেছিলেন সামদানি, কিন্তু টিকিট যে দুটির বদলে তিনটি কাটা হয়েছে, মিথিলা তা জানতেন না। মিথিলার শাশুড়িও সঙ্গে যাচ্ছেন।
যত দিন গড়াল দেখা গেল, মা ছাড়া কিছুই বোঝেন না সামদানি। খুব কম দাওয়াতেই কেবল স্বামী-স্ত্রী গেছেন। সবখানেই কোনো না কোনোভাবে সামদানির মা যুক্ত হয়ে যান।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়টি সেদিন ঘটল, যেদিন মিথিলা জানতে পারলেন, নিজের প্রথম ক্রাশ থেকে শুরু করে ক্লাস পালিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখার যে গোপন গল্প তিনি তাঁর স্বামীকে বলেছেন; সেটিও জেনে গেছেন শাশুড়ি! অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার খুব একান্ত গল্পটিও আর গোপন থাকেনি।
সামদানি এত দিন তো সব কথা মায়ের সঙ্গেই শেয়ার করে এসেছেন। বিয়ে করেছেন বলে মাকে তো আর দূরে ঠেলে দিতে পারেন না! শেষ পর্যন্ত মিথিলা-সামদানির রাজকীয় বিয়ে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। গোটা দুনিয়া জেনেছে, মিথিলা একমাত্র ছেলেকে তাঁর মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
কাছাকাছি ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে নুরজাহান আর সোহেলকে। বাবাহারা সোহেল আর তাঁর বোন আসমাকে একাই বড় করেছেন মা। নানা সংকটে তিনজন একে অন্যের ঢাল হয়ে থেকেছেন।
বেতনের সব টাকা তাই আগের মতোই মায়ের হাতে তুলে দেন সোহেল। নুরজাহানের জন্য হাতখরচটাও বরাদ্দ থাকে না। নুরজাহান লেখাপড়া শুরু করতে চাইলে মায়ের অনুমতি মেলে না। ফলে সোহেলের স্ত্রীর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এরই মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন নুরজাহান; কিন্তু ছেলে এখনো বাবা হওয়ার মতো দায়িত্বশীল হননি—এমন অজুহাত মায়ের। ফলে নুরজাহানকে গর্ভপাত করাতে বাধ্য করেন সোহেল।
ক্লান্ত শরীর আর ভেঙে যাওয়া মন নিয়ে বাবার বাড়ি ফিরে আসেন নুরজাহান। তাঁদের এখনো বিচ্ছেদ হয়নি। কিন্তু দুজন আলাদা থাকছেন। মা অনুমতি না দেওয়ায় নুরজাহানকে ফিরিয়ে আনতে পারছেন না সোহেল।
পিয়া আর শান্তনুর সমস্যা আবার অন্য রকম। বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্র শান্তনুর সঙ্গে লম্বা সময় প্রেমের পর বিয়ে। শান্তনুর বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ এলে দুজন প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন; কিন্তু শান্তনুর মা ঘোষণা করেন, পিয়ার যাওয়া চলবে না।
এতে শান্তনুর লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটবে। ছোটবেলা থেকে যেভাবে শান্তনুর বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা আটকেছেন, সেই লেখাপড়ার অজুহাতে পিয়াকেও আটকে দেন মা। এমনকি শান্তনুকে ফোনে কথা বলে যাতে ‘মনোবল ভেঙে না দেন’ সেদিকেও শাশুড়ির কড়া নজর।
প্রথম তুষারপাতের ছবিও শাশুড়ির ফোন থেকে দেখতে হয় পিয়াকে। পিয়া সংসারে তাঁর অবস্থান জানতে চাইলে আকাশ থেকে পড়েন শান্তনু। কারণ,মা তো তাঁর ভালোর জন্যই পিয়াকে আমেরিকায় যেতে দেননি।
হতবাক পিয়া আবিষ্কার করেন, তাঁর দীর্ঘদিনের প্রেমিককে তিনি চিনতে পারছেন না। তাঁর জন্য করিডরে অপেক্ষা করা ছেলেটি কেবল তাঁর মায়ের ছেলে। পিয়ার পার্টনার তিনি হয়ে উঠতেই পারেননি। পাঁচ বছর প্রেম টিকলেও পিয়া-শান্তনুর বিয়ে টিকেছিল দেড় বছর।
সামদানি, সোহেল, শান্তনু—তিনজনকেই এক কথায় বলা যেতে পারে ‘মাম্মাস বয়’। এঁরা বিয়ে করেছেন ঠিকই; কিন্তু মায়ের আঁচলের নিচ থেকে বের হয়ে স্ত্রীর হাত ধরতে পারেননি। বিয়ের পর স্ত্রীর জন্য সম্মানের যে আলাদা জায়গা তৈরি করতে হয়, সেটি তাঁরা করতে পারেননি।
স্বামী এমন হলে কী করবেন স্ত্রী
মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইডের মাস্টার ট্রেইনার ডাক্তার নাজিয়া হক বলছিলেন, মায়ের সঙ্গে সংযোগ অবশ্যই থাকতে হবে; কিন্তু সেটি যেন হয় স্বাস্থ্যকর। দেখা যায়, কিছু ছেলের সঙ্গে মায়ের অ্যাটাচমেন্ট এত বেশি থাকে যে তাঁরা স্ত্রীকে যথাযথ জায়গাটুকু দিতে পারেন না। এটা তখন পরিবারে সমস্যা তৈরি করে। একজন পুরুষের মধ্যে বিয়ের আগে এতটুকু ম্যাচিউরিটি আসা উচিত যে তিনি তাঁর মাকে মায়ের জায়গায় আর স্ত্রীকে স্ত্রীর জায়গায় রাখতে পারেন।
যখনই একজন পুরুষ এই ভারসাম্য রাখতে পারবেন না, একজনের সঙ্গে সমস্যার সৃষ্টি হবে। তিনি তাঁর মায়ের দিকে যদি বেশি ঝুঁকে থাকেন, তখন তাঁকে ‘মাম্মাস বয়’ বলা হয়। মায়ের সঙ্গে ছেলের এই অতিরিক্ত সংযুক্তি স্ত্রীর জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
বিয়ের পর যদি বুঝতে পারেন যে স্বামী আসলে একজন ‘মাম্মাস বয়’, তখন তাঁকে নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। স্বামীর সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় বসে কথা বলতে হবে। তাঁকে বোঝাতে হবে, মা তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাতে কোনো সন্দেহ নেই;
সবাই একই পরিবারের সদস্য, সেখানে সবাইকেই যথাযথ গুরুত্ব আর যথাযথ সম্মান দিতে হবে।
এ ক্ষেত্রে ছেলের মায়েদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে তাঁর সন্তানের আলাদা জীবন শুরু হচ্ছে। তাঁকে সহযোগিতা করতে হবে, যেন তিনি নতুন জীবনে ভালো থাকেন। ছেলের স্ত্রীকে প্রতিযোগী না ভেবে তাঁকে ছেলের জীবনের নতুন গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখতে হবে। ছেলের বউ যে কাজের লোক না বা সাজিয়ে রাখার কোনো জিনিস না, সেটি বুঝতে হবে।
সম্পর্ক সুন্দর রাখতে পরিবারগুলোর জন্য একটি পরামর্শও দিলেন নাজিয়া হক। আমাদের দেশে প্রতিটি পরিবারের উচিত বিবাহপূর্ব কাউন্সেলিং বা আলোচনার মধ্য দিয়ে যাওয়া। এই আলোচনা দুই পরিবারের মধ্যে খোলাখুলি হওয়া জরুরি। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হবে, দায়িত্ব কেমন হবে, পরিবারে কার কী প্রত্যাশা, কে কী ভাবছেন—এসব নিয়ে আলোচনা করে তারপর সম্পর্ক শুরু করা উচিত।