তর্কবিতর্ক মানেই যেন নেতিবাচক কিছু। বিশেষ করে দম্পতিদের মধ্যে কোনোরকম তর্ক হওয়াই উচিত নয় বলে মনে করেন অনেকে। আদতে তা ভুল ধারণা। কিছু কিছু বিষয়ে তর্ক না করাই বরং সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সভ্য উপায়ে মতপার্থক্যের সমাধান করা আদতে আমাদের সম্পর্কের জন্য দারুণ উপকারী। সুস্থ বিতর্ক আপনাকে এবং আপনার সঙ্গীকে আগের চেয়ে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারে। মোটকথা, কিছু বিষয়ে তর্ক এড়িয়ে চলা সম্পর্কের জন্য ভালো তো নয়ই, বরং খারাপ। এমনই কিছু বিষয় নিয়ে জানুন—
হিংসা ও সন্দেহ নিয়ে দম্পতিরা সাধারণত খোলামেলাভাবে আলাপ করেন না। আলাপ না করতে করতে অনেক সময় সমস্যা চরমে পৌঁছায়। ধরা যাক, স্বামী বা স্ত্রীর একজন খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বা বন্ধু আছেন, যাঁর সঙ্গে তিনি একই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক নেই। এখন স্বামী বা স্ত্রী সেই বান্ধবী বা বন্ধুকে নিয়ে সঙ্গীকে সন্দেহ করছেন। কিন্তু এ নিয়ে সঙ্গীকে একটি কথাও বলছেন না এই ভেবে যে তিনি কথাগুলো কীভাবে নেবেন; রেগে যাবেন কি না! আদতে বিষয়গুলো মনের মধ্যে পুষে না রেখে খোলাখুলি আলাপ করা দুজনের জন্যই উপকারী। নিজের উৎকণ্ঠা প্রকাশ করলে বরং আলোচনা ফলপ্রসূ হয়। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক আরও সুন্দর এবং পরিপূর্ণ হয়।
স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাঁটির পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে কথা বলাবলিও বন্ধ থাকে। অনেকে চিন্তায় পড়ে যান, ও কি সত্যিই আমাকে ওর জীবনে আর চায়? ও কি আমাকে আগের মতো আর ভালোবাসে? এসব ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দুজনের ‘ইগো’ বা অহংবোধ এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব। দুজনেই ভাবেন, ও আগে আমার সঙ্গে কথা বলুক। আমি কেন আগবাড়িয়ে কথা বলতে যাব? এভাবে সম্পর্ক দিন দিন খারাপের দিকেই যায়। অথচ খোলাখুলিভাবে কথা বলা, ইতিবাচক এবং গঠনমূলকভাবে তর্ক করলে সমস্যার সমাধান মেলে। ছোট-বড় সব ব্যপারে উন্মুক্ত আলোচনা স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব পরিচিত একটি সমস্যা হলো, সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং বাস্তবায়নের সমস্যা। এ ক্ষেত্রে শুধু ‘কার সিদ্ধান্ত সঠিক, কার ভুল’ এই প্রশ্নই জড়িত থাকে না, থাকে আরও গভীর কিছু বিষয়। আস্থা, সম্মান এবং প্রত্যেকের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দই এসব দ্বন্দ্বের মূল কারণ। একজন হয়তো ভাবছেন, তিনি নিজে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তাই তিনি নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলেন সঙ্গীর ওপর। কিন্তু অপরজন এতে হীনমন্যতায় ভোগেন, নিজেকে পরনির্ভরশীল ভাবতে থাকেন, তার দম বন্ধ হয়ে আসছে বলে মনে হতে থাকে। অতীতে কোনো বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো মতানৈক্য থাকলে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব কঠিন হয়। তাই মুক্ত আলোচনা বা তর্কবিতর্কের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যৌথভাবে। মতানৈক্য দেখা দিলে যতটা সম্ভব ছাড় দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে, যাতে সঙ্গী অসম্মানিত বোধ না করেন।
টাকাপয়সার ব্যাপারে দম্পতিদের মধ্যে তর্কবিতর্ক হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি দুই রকম। একজন হয়তো ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করাকে গুরুত্ব দেন। আরেকজন বর্তমানের জন্যই স্বতঃস্ফূর্তভাবে খরচ করতে পছন্দ করেন। দুজনের বেড়ে ওঠার পরিবেশ-পরিস্থিতি, পারিবারিক আবহ, অতীত অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টাকাপয়সার ব্যাপারে পরস্পরের সঙ্গে নিঃসংকোচে আলোচনা করতে হবে। তাহলেই একসঙ্গে দুজনই ভবিষ্যতে সুখী হবেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার প্রশ্নে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে রাখঢাক ছাড়াই তর্কবিতর্ক হওয়া ভালো। শুধু সম্পর্কের খাতিরে নিজের স্বপ্ন আর পরিকল্পনাগুলো ধামাচাপ দিয়ে রাখলে পরবর্তী সময়ে স্বপ্নপূরণ না করতে পারার জন্য জীবনসঙ্গীকে দায়ী মনে হতে পারে। নিজেদের জীবনের লক্ষ্যগুলো নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে মুখোমুখি বসে ইতিবাচক আলোচনা করাই ভালো ফল নিয়ে আসে।
যখন দম্পতিদের মধ্যে কোনো একজন কিংবা উভয়েই স্বাধীনতা, মুক্তজীবন কিংবা শুধুই নিজেকে দেওয়ার মতো যথেষ্ট সময়ের অভাব বোধ করেন, তখনই দম্পতিদের মধ্যে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে বাহাস শুরু হয়। সঙ্গীর ওপর সুখ এবং নিরাপত্তার জন্য খুব বেশি নির্ভরশীল হলেও এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়। এসব দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করার জন্য স্পষ্ট সীমারেখা টানুন। নিজের যত্নকে অগ্রাধিকার দিন। সম্পর্ককে লালন করার ক্ষেত্রেও আপনার ব্যক্তিগত আগ্রহ এবং আত্মপরিচয় বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতি একসঙ্গে সময় কাটানো এবং একান্তই নিজের জন্য সময় বরাদ্দ থাকার মধ্যে একটি সুস্থ ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
দাম্পত্যে কখনো কখনো কারও মনে হতে পারে যে সঙ্গী তাঁর প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ এবং সময় দিচ্ছেন না, সম্পর্ককে আগের মতো অগ্রাধিকার দিচ্ছেন না। কখনো কখনো মনে হতে পারে, কিছু একটা সমস্যা আছে; কিন্তু সমস্যাটা যে কী, তা কেউ বুঝতে পারেন না। এই পরিস্থিতি বিভিন্ন কারণে আসতে পারে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একজন সঙ্গীর এ রকম মনে হলেও ঝামেলা এড়াতে তাঁরা অন্যজনকে কিছুই বলেন না। উৎকণ্ঠার কথা এভাবে চেপে রাখা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া