ভারতীয় গায়ক অনুব জৈনের একটি গান সম্প্রতি তরুণদের মধ্যে নানা কারণেই আলোচিত। ‘হাস্ন’ শিরোনামের সেই গানে এমন একটি মেয়ের গল্প বলা হয়েছে, যে একটি জটিল সম্পর্কের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে বারবার। কী সেই জটিল সম্পর্ক? ‘সিচুয়েশনশিপ’ (দায়হীন সম্পর্ক)। না বন্ধুত্ব, না প্রেমের এই সম্পর্কে মানুষ উথালপাতাল প্রেমে পড়তে চায় না। প্রাণ ভরে ভালোবাসার চেয়ে তারা বর্তমানে থাকতে বেশি পছন্দ করে। দুজনের কারোর মধ্যেই যেটা আজীবন টিকিয়ে রাখার মতো কোনো প্রতিশ্রুতি থাকে না। গানে মেয়েটি বারবার বলছিল, সে এই সিচুয়েশনশিপের দুনিয়াটা মানতে পারছে না। তাই পুরোনো দিনের মতো সম্পর্কে ফিরতে চায় সে, যেখানে দুটি মানুষ একসঙ্গে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার সংকল্প করে।
সম্পর্কের এই জটিল ধরনকেই বলা হচ্ছে ‘সিচুয়েশনশিপ’। নব্বইয়ের দশকের আগের প্রজন্মের কাছে শব্দটি অপরিচিত শোনাতেই পারে। তবে যাঁরা বিংশ শতকের শেষে বা একবিংশ শতকে জন্মেছেন, তাঁদের কাছে এটি বেশি পরিচিত। যাঁদের জেনারেশন জি বা জেনারেশন আলফা বলা হয়, তাঁরাই এ ধরনের সম্পর্কে জড়াচ্ছেন বেশি। কখনো জেনেশুনে, কখনো দীর্ঘ সম্পর্কে জড়ানোর ভীতি থেকে তাঁদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে গোলমেলে এই সম্পর্ক।
সিচুয়েশনশিপ (দায়হীন সম্পর্ক) জটিল সম্পর্কের রসায়ন, যেখানে হৃদয় আদান-প্রদানের ব্যাপার থাকলেও প্রতিশ্রুতি থাকে না। তরুণ-তরুণীরা সম্পর্কে জড়াচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এই সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করতে বললে তাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারছেন না। সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা থাকে। যুগলেরা প্রেমিক-প্রেমিকার মতো একসঙ্গে সময়ও কাটান। তবে সম্পর্কটি ততক্ষণই থাকে, যতক্ষণ কোনো পক্ষই এই সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত না করে। অর্থাৎ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ ভাবে না। আপাতদৃষ্টে তাই যে কেউ তাঁদের দেখে ধন্দে পড়তে পারেন। কারণ, এখানে দুজন ব্যক্তির মধ্যে যে কেউ, যেকোনো সময় অন্যজনকে ছেড়ে চলে যেতে পারে। কারণ, সিচুয়েশনশিপে আর যা-ই থাকুক, প্রতিশ্রুতি থাকে না!
যেহেতু সিচুয়েশনশিপের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই, তাই এই সম্পর্কের ধরন সবার ক্ষেত্রে এক না-ও হতে পারে। যেমন—
১. ধরা যাক, বিচ্ছেদের পরপরই কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন। সেখানে দুজনের কেউই কাউকে ছাড়তে চান না, আবার নতুন করে জড়াতেও চান না। কারণ, আপনার মধ্যে সম্পর্কে টিকে না থাকা বা হারিয়ে ফেলার ভয় কাজ করছে।
২. নতুন কোথাও বেড়াতে গিয়ে বা প্রশিক্ষণে নতুন একটি মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো। যত দিন ওই জায়গায় ছিলেন, তাঁর সঙ্গে সময় কাটল। হয়তো ঘনিষ্ঠভাবেই কাটল। কিন্তু যখনই ওই জায়গা থেকে ফিরে এলেন, একজন অপরজনের সঙ্গে নতুন করে আর যোগাযোগ রাখলেন না।
৩. বন্ধুমহলে আপনারা হয়তো ‘পারফেক্ট ফর ইচ আদার’। সঙ্গী হিসেবে অপর ব্যক্তিটি আপনার পছন্দেরও, তারপরও আপনি কখনোই তাঁকে পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন না। কারণ, তাঁকে বিয়ে করার কোনো পরিকল্পনা আপনার নেই।
৪. হতে পারে তাঁর সঙ্গে আপনার ভার্চ্যুয়াল জগতে পরিচয়। সেখান থেকে ভালো লাগা। দিনের পর দিন আপনারা কথা বলে যাচ্ছেন। অথচ ভালোভাবে একে অন্যের পরিচয়টুকুও জানেন না। কারণ, এই ভালো লাগার ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা দুজনের কারোরই নেই।
৫. প্রেমিক-প্রেমিকার মতোই হয়তো বিশেষ দিনে বেড়াচ্ছেন। রং মিলিয়ে পোশাক পরছেন। অন্তরঙ্গ হচ্ছেন দুজনের সম্মতিতেই। ঘুরছেন, ফিরছেন, কিন্তু সেটা কত দিনের জন্য, তা কেউই জানেন না। জানার কোনো ইচ্ছেও নেই।
সিচুয়েশনশিপ সম্পর্কে ধারাবাহিকতা থাকে না। থাকে না কোনো অঙ্গীকার বা সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা। তাই এ ধরনের সম্পর্ক একটা সময় পরে হতাশা ও উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যা বাড়িয়ে তোলে। অনেক সময় দেখা যায়, একজন ব্যক্তি সম্পর্ক না এগোনোর জন্য অবচেতনভাবে নিজেকেই দোষারোপ করতে থাকেন। এতে নিজের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। সংবেদনশীল ব্যক্তিরা এ সমস্যাগুলো সাধারণত এড়াতে পারেন না। এখান থেকে দীর্ঘ অবসাদ ও বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করেন তাঁরা। দীর্ঘদিন সিচুয়েশনশিপে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার আত্মবিশ্বাস কমে যেতে পারে। সম্পর্কে থাকাকালে সন্দেহপ্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে। আবার নিজেকে তিনি ভালোবাসার অযোগ্যও ভাবতে পারেন। কখনো কখনো তাই সিচুয়েশনশিপ একটি বিষাক্ত সম্পর্কে পরিণত হয়।
সিচুয়েশনশিপ যদিও কোনো অঙ্গীকারবদ্ধ সম্পর্ক নয়, তারপরও সেখান থেকে বের হয়ে আসা মানসিকভাবে কষ্টের কারণ হতে পারে। কারণ, এমন সম্পর্ক থেকে কখন বের হয়ে আসা উচিত, সেটা নিয়ে তাঁদের মধ্যে কোনো স্পষ্ট ধারণা থাকে না। আর তাই পরিণতি নেই, এমন সম্পর্কও আমরা নিজের অজান্তে বেশির ভাগ সময় চালিয়ে নিয়ে যাই।
ঢাকার স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী শারমিন হক বলেন, ‘গত বছর বেশ কয়েকজন রোগী এ ধরনের সম্পর্ক নিয়ে আমার কাছে এসেছেন। যেই সম্পর্কে কোনো কমিটমেন্ট নেই, সেটা তো কোনো সম্পর্কই না। তাই সেটা নিয়ে খুব বেশি ভাবনারও সুযোগ নেই। কেউ যদি এমন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চান, তাহলে শুরুতেই তাঁকে একটি স্বাভাবিক সম্পর্কে জড়াতে হবে, যেখানে কমিটমেন্ট থাকবে। তাহলেই সেটা তিনি ধৈর্য ধরে লালন-পালন করবেন, ইন্টিমেসি (অন্তরঙ্গতা) তৈরি হবে।’
সিচুয়েশনশিপে দুজন ব্যক্তির চাওয়া ভিন্ন হলে, সম্পর্ক উপভোগের চেয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া চাপ মনে হলে সেখান থেকে বের হয়ে আসুন। আর আপনি যদি দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে যেতে চান, তবে আপনার সঙ্গীর সঙ্গে সরাসরি, স্পষ্টভাবে আলোচনা করুন। সঙ্গীর এ ক্ষেত্রে আপত্তি থাকলে সেই সম্পর্কে আর সময় নষ্ট করবেন না। কষ্ট হলেও সেই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসুন। সঙ্গীর অনুভূতিকে সম্মান জানান। নিজের অনুভূতির প্রতি সদয় ও শ্রদ্ধাশীল থাকুন।