সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে ভালোবাসার ধরনও। সবকিছুতেই এখন অনলাইনের বাড়বাড়ন্ত। প্রেমের ক্ষেত্রেও তা–ই। চিঠির প্রেম তো অনেক আগেই অতীত হয়েছে, ফোনে কথোপকথনের সময়ও কি ফুরিয়ে এল! একটা সময় সামনাসামনি দেখা করার যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, তার অনেকটাই এখন হাইব্রিড ডেটিংয়ের দখলে চলে গেছে। এ ধারণাকেই কেউ কেউ এখন বলছেন ‘নিও নরমাল’।
চিঠির প্রেম এখন ডেটিং অ্যাপে ঢুকে গেছে। ফোনের স্ক্রিন ডান-বাঁ করলেই মিলছে পছন্দের মানুষ। বাংলাদেশেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে বেশ কয়েকটি ডেটিং অ্যাপ। সেখান থেকেই অনেকে খুঁজে নিচ্ছেন পছন্দসই সঙ্গী। ডেটিং অ্যাপে পরিচয়, অতঃপর কথা বলা, দেখা করা। মনের সঙ্গে মন মিললেই মন দেওয়া-নেওয়া, এ সমীকরণকেই আরও এক ধাপ উপরে নিয়ে গেছে হাইব্রিড ডেটিং।
হাইব্রিড ডেটিং অনেকটা হাইব্রিড অফিসের মতো। করোনাকালীন প্রায় প্রতিটি অফিসই যেমন বাড়িতে চলে গিয়েছিল, হাইব্রিড ডেটিংও অনেকটা তেমন। শুধু কাজের পরিবর্তে প্রেম। প্রেম করা মানেই নিয়মিত দেখা করা, একই সঙ্গে সময় কাটানো, এ ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসছে এই প্রজন্ম; বরং তারা প্রেম করার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছে হাইব্রিড ধারণা। যেখানে কালেভদ্রে হয়তো দেখা হবে, কিন্তু প্রেমের বড় একটা অংশই থাকবে স্ক্রিনবন্দী। তাদের ডেটগুলোও হবে ভিডিও কনফারেন্সে। তবে এটাকে ভিডিও কলে শুধু কথা বলা ভেবে থাকলে ভুল হবে। হাইব্রিড ডেটিংয়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া, নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করা, পছন্দের মানুষের জন্য সারপ্রাইজ, সবকিছুই থাকে। পার্থক্য শুধু একটাই, সামনাসামনি দেখা হওয়ার বদলে ডেটিং হয় ভিডিও স্ক্রিনে।
স্মার্টফোন হাতে চলে আসার পর থেকে বেশির ভাগ প্রেমই বন্দী হয়ে পড়েছে মুঠোফোনের ছোট্ট স্ক্রিনে। শুধু বন্দী হয়ে পড়েছে বললে ভুল হবে, বর্তমান সময়ের বেশির ভাগ প্রেম শুরুও হচ্ছে স্মার্টফোনে। পরিচয় থেকে পরিণয়—সবটাই ঘটছে ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম ও অ্যাপে। যে কারণে দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্কটাও বেশ ধূসর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত কথা বলা, যখন–তখন চাইলেই যোগাযোগ করতে পারার সুবিধা যেমন আছে, তেমনই চাইলেই যখন–তখন মনের মানুষকে একনজর দেখতে পারাও সম্ভব। যে কারণে বেড়েছে হাইব্রিড ডেটিং।
তবে এ ধরনের সম্পর্কে ভুল মানুষের প্রেমে পড়ার আশঙ্কাও বেশি থাকে। একটা মানুষের কাছে বসা, হাত ধরা বা তার শরীরী ভাষা বোঝার কোনো উপায় অনলাইনে থাকে না। প্রেমের এই পালে হাওয়া দিয়েছে ডেটিং অ্যাপগুলো। করোনার সময়ে সবাই যখন ঘরবন্দী, বাইরে বেরোনোই যখন ভয়ের, তখন যুগলেরা বেছে নিয়েছিলেন এই হাইব্রিড ডেটিং। কথা বলা, দেখা করার সবটাই যখন স্ক্রিনের ভেতরে থেকে হচ্ছে, তাহলে রোমান্টিক ডেটটাই–বা বাদ পড়বে কেন? ফোনের স্ক্রিনের সামনে কিছুটা সময় একে অপরের সঙ্গে কাটানো, অস্থির সময়ে এর থেকে ভালো মুহূর্ত আর কীই–বা হতে পারে!
অনেকে তো নিজের রুমটাকেই রীতিমতো রেস্তোরাঁ বানিয়ে ফেলেন। ঢাকার একটি কলেজে পড়ুয়া তরুণ রেহান (ছদ্মনাম)। একটি অ্যাপে চট্টগ্রামের এক তরুণীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়। বাস্তবতা দুজনেরই জানা, তাই শুরু থেকেই সরাসরি দেখা করার চেয়ে অনলাইন ডেটিং করেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তাঁরা। রেহান বলেন, ‘আমাদের এক বছরের প্রেম। এর মধ্যে সরাসরি দেখা হয়েছে দুইবার। ফোনে কিন্তু কথা হয় প্রতিদিন, একাধিকবার। সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন আমরা অনলাইনে গুছিয়ে ডেট করি। পছন্দের খাবার সাজিয়ে, সুন্দর পোশাক পরে একজন আরেকজনের সামনে বসি। লম্বা সময় ধরে আমাদের আলাপ চলে।’
সময়টা স্বাভাবিক হয়ে এলেও তাই হাইব্রিড ডেটিংয়ের আইডিয়া শেষ হয়ে যায়নি; বরং আরও নতুনত্ব নিয়ে যে সামনে আসছে, এই তরুণের আলাপ থেকেই তা বোঝা যায়। আগে হয়তো ছিল, করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভয়। সেই জায়গা নিয়েছে এখন দূরত্ব, অতিরিক্ত খরচ আর ট্রাফিকের ভয়। বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া মানেই একগাদা টাকা খরচ, বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রাফিক ঠেলে গন্তব্যে পৌঁছানো। আবার সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রেম শেষে সময়মতো বাড়ি ফেরা। ব্যস্ত দিনে এতটা কষ্ট করতে অনেকেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। তাদের জন্যই যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে হাইব্রিড ডেটিং। বিশেষ করে ‘লং ডিসটেন্স’ সম্পর্কে থাকা ব্যক্তিদের জন্য ‘হাইব্রিড ডেটিং’ আশীর্বাদ।
তাই বলে দেখাসাক্ষাৎ যে একেবারেই বন্ধ থাকে, তা কিন্তু নয়; বরং নিয়মিত বিরতিতে ঠিকই দুজনের দেখা হয়। কোথাও বসে একান্তে প্রেমের ফুসরতও মেলে। হাইব্রিড প্রেম বা ডেটিং সাধারণ ডেটিংয়ের বিকল্প নয়; বরং এই ধারণা প্রেমকে আরেকটু ভিন্নমাত্রা দিয়েছে মাত্র। দিন শেষে যত যা–ই হোক, সামনাসামনি দেখা করা, কথা বলার মধ্যে যে প্রেম থাকে, তা কী আর ফোনের স্ক্রিনের সামনে বসে পাওয়া সম্ভব?
‘এখানে বিশ্বাসটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ
তানজিলা ইফাত তাসকিন, কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট।
অনেকে না চাইলেও বাস্তবতা হচ্ছে, হাইব্রিড ডেটিং সমাজে বিদ্যমান। কেউ কেউ মনে করেন, এটা শুধু জেন–জিরা করছে, এই ধারণাটাও ভুল। আমার কাছে এমন অনেক রোগী আসেন, যাঁদের বয়স ৩৫–৪০ বছর। তবে এটাও সত্যি, এই সম্পর্কটা জেন–জিদের মধ্যেই বেশি। কেউ হয়তো পরিবার থেকে দূরে থাকায় এমন সম্পর্কে জড়িয়েছেন, কেউ আবার বিচ্ছেদের পর বা একাকী থাকার ফলে এমন সম্পর্কে আগ্রহী হয়েছেন, একঘেয়েমি অথবা বহুগামিতার প্রবণতাও এখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে।
এ ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি। একে অন্যকে বুঝতে পারা, অপর পক্ষের প্রত্যাশা ও চাহিদাগুলো জানতে চাওয়া ও নিজেরটা জানানো এবং সম্পর্কের অর্থটি তার কাছে কেমন, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। তাই যেকোনো সম্পর্কে জড়ানোর আগে হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় সিদ্ধান্ত না নিয়ে একটু সময় নিন। এরপর আবেগ ও যুক্তির সংমিশ্রণে একটি সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে। যে সময়টা নিচ্ছেন, সেটা নিজেকে এবং অন্যকে জানাশোনার ব্যাপারে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেহেতু হাইব্রিড প্রেমকে কেউ কেউ একটা পর্যায়ে যৌনতার দিকে নিয়ে যান, এ বিষয়েও তাই সাবধান থাকতে হবে। বিশেষ করে এসব ক্ষেত্রে নারীরা বেশি ভিকটিম হয়ে থাকেন। তাই কোনো চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার আগে সব দিক বিবেচনা করে নেওয়া জরুরি। অনেকে অনলাইনের এমন ফাঁদে পড়ে বারবার ভুল করতে থাকেন। ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকাপয়সা আদায় করে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে শোনা যায়। তাই অনলাইনে পরিচয় হলেই মানুষটাকে দ্রুত বিশ্বাস করা যাবে না। আগে বিশ্বাস অর্জন করা দুই পক্ষের জন্যই ভালো।
যাঁরা খুব দ্রুত এ ধরনের সম্পর্কের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে যেতে থাকেন, তাঁরা প্রতারিত হন বেশি। একাকিত্ব দূর করার জন্য যে ডেটিং শুরু করছেন, সেটা যেন অল্প দিন পরেই নিজেকে আরও বেশি একা করে না দেয়। পরে যে বিষয়গুলো ঘটতে পারে, আগেই সেসব ভাবনা নিজের মধ্যে রাখতে হবে। অনলাইন ডেটিং করার সময় একান্ত মুহূর্তের কোনো ছবি ফোনে রেখে দিলে সেটা অন্যভাবেও বেহাত হতে পরে। ফোন চুরি হলে বা হ্যাকড হলেও তৃতীয় কেউ সেটা দিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে পারে। তাই সব দিক ভেবে কিছুটা ধীরেই এগোতে হবে।