মা-বাবার আদর-ভালোবাসায় বেড়ে ওঠে শিশু। মা-বাবাই হয়ে ওঠেন ছোট্ট শিশুর পরম আশ্রয়। কিন্তু এমন মা-বাবাও রয়েছেন, যাঁরা শিশুর বড় হয়ে ওঠার পথে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে থাকেন। নিজেদের অজান্তেই অনেক সময় এমনটা ঘটতে থাকে। তাঁরা হয়তো বুঝতেও পারেন না যে তাঁদের আচরণের কোন দিকটি শিশুর বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিশু–কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. টুম্পা ইন্দ্রানী ঘোষ বলেন, দম্পতির মধ্যকার সুসম্পর্ক শিশুর বিকাশের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা অনুকরণপ্রবণ হয়ে থাকে। মা-বাবার আচরণের যেকোনো একটি নেতিবাচক দিকই শিশুকে ভুল আচরণের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। সন্তানের মধ্যে আচরণগত সমস্যা লক্ষ করলে অভিভাবকের নিজের আচরণের বিভিন্ন দিক নতুন করে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
‘টক্সিক প্যারেন্টিং’-এর বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন এই চিকিৎসক। টক্সিক প্যারেন্টিংয়ের শিকার হলে সন্তানের মধ্যে যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে, তেমন কিছু আচরণগত সমস্যা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক আজ।
অতিরিক্ত জেদ
মা-বাবা ‘টক্সিক’ হলে শিশুর চাওয়া-পাওয়াকে তাঁরা কম গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অনেক সময় শিশুর ‘সামান্য’ একটা কথা শুনতেও তাঁরা বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলেন। শিশুর কাছে সেই ‘সামান্য’ কথাটাই হয়তো ‘দারুণ’ কিছু ছিল। ‘টক্সিক’ মা-বাবার মধ্যে শিশুদের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতাও দেখা যায়, যাকে বলা হয় ‘হেলিকপ্টার প্যারেন্টিং’। সব মিলিয়ে শিশু নিজেকে বঞ্চিত বোধ করে। ছোটখাটো বিষয় নিয়েও সে তখন অতিরিক্ত জেদ করতে পারে।
আবেগ নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা
রাগ মানবচরিত্রের ভয়ংকর দিক। শিশু রেগে গিয়ে যদি চিৎকার-চেঁচামেচি করে, কাউকে মারতে উদ্যত হয় কিংবা কোনো কিছু ভাঙতে চায়, তাহলে অবশ্যই ভেবে দেখুন, সে কেন এমন ‘টক্সিক’ হয়ে যাচ্ছে। হাসি-কান্না মানুষের আচরণের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। তবে অল্পতেই ভেঙে পড়া কিন্তু একটি অস্বাভাবিকতা। টক্সিক অভিভাবক শিশুর আবেগের মূল্য দেন না। সে ক্ষেত্রে শিশুর এই অবমূল্যায়িত আবেগের অনিয়ন্ত্রিত বহিঃপ্রকাশ দেখা দেয়।
ব্যক্তিত্বসংক্রান্ত সমস্যা
স্বাভাবিকভাবে শিশুরও একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। কিন্তু টক্সিক আচরণের শিকার শিশুরা আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভীত আচরণ করে। একেবারে চুপচাপ হয়ে গিয়ে অন্য মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে চলতে পারে এসব শিশু। ব্যক্তিত্বের দুর্বলতা কিংবা অস্বাভাবিকতা লক্ষ করলে অবশ্যই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিন।
দুশ্চিন্তা, হতাশা, অতিরিক্ত অস্থিরতা
এসব শিশু দুশ্চিন্তা বা হতাশায় ভুগতে পারে। অতিরিক্ত অস্থিরতাও প্রকাশ পেতে পারে তাদের আচরণে। এমনকি বড় হওয়ার পরও জীবনের চড়াই-উতরাই পেরোতে গিয়ে তাদের এ ধরনের মানসিক সমস্যায় পড়তে হতে পারে।
দক্ষতা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়া
একটি শিশু বিভিন্ন কারণেই পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়তে পারে। তবে কখনো কখনো অন্য কোনো কারণ না থাকলেও কেবল মা-বাবার ‘টক্সিক’ আচরণের কারণেই শিশু একাডেমিক ও অন্যান্য বিষয়ে দক্ষতা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।
সম্পর্কজনিত জটিলতা
সহপাঠী বা গুরুজনদের সঙ্গে মেশার সময়ও শিশুরা ‘সামাজিক’ আচরণ করতে ব্যর্থ হতে পারে। অন্যদের সম্মান না করা কিংবা অন্যদের সীমার মধ্যে অনুপ্রবেশের মতো আচরণ তার ভেতর দেখা দিতে পারে। একটু বড় হওয়ার পর সে ‘বিশেষ’ কারও সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে গিয়েও ভুল আচরণ করে ফেলতে পারে। বারবার কারও না কারও সঙ্গে গভীর সম্পর্কে জড়ানোর মতো ভুলও করতে পারে সে।