স্বামী মারাত্মক সন্দেহপ্রবণ, বিবাহিত জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার পথে

পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।

পাঠকের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মেহতাব খানম
পাঠকের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মেহতাব খানম

প্রশ্ন: আমার স্বামী তেমন কিছুই করেন না। আসলে মানসিক কিছু সমস্যা ও প্রচণ্ড রাগের কারণে তিনি কিছু করতে পারেন না। যেখানেই যান, ঝামেলা তৈরি করেন। ছোটবেলায় মা–বাবার মধ্যে সমস্যা ও দূরত্ব থাকার কারণে আমার স্বামী ও তাঁর ভাই-বোনেরা জীবনে অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছেন। কাউকে তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না। সারাক্ষণ নেতিবাচক চিন্তা করেন। মানসিক চিকিৎসকের কাছে যেতে তিনি একদমই আগ্রহী নন। তাঁর মারাত্মক সন্দেহপ্রবণতার কারণে আমাদের বিবাহিত জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। সব সময় বাজে বাজে কথা, শারীরিক আঘাত করা, কাজ না করে আমাকে পাহারা দেওয়া, রাতে দরজার পাশে শুয়ে থাকার মতো নানা ধরনের কাজ তিনি করেন। আমি কী করব, বুঝতে পারছি না। খুবই কষ্টে আছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

উত্তর: আপনাদের বিয়েটা কি আগে থেকেই সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে হয়েছে, নাকি পরিবারের পছন্দে হয়েছে, জানাননি। কত দিন ধরে বিয়ে করেছেন, সন্তান আছে কি না, জানালে ভালো হতো। এগুলো জানলে বুঝতে পারতাম, আপনি এই জীবনের সঙ্গে কতটা জড়িয়ে গেছেন। কেননা, মেয়েরা অনেক সময় বলে থাকেন, ‘এত দিন একসঙ্গে থাকার ফলে মানুষটার ওপর কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে। তা ছাড়া তিনি তো আমার সন্তানের বাবা। কী করে তাঁকে ছেড়ে চলে যাই?’ আপনি জানিয়েছেন, আপনার সঙ্গী কোনো কাজ করেন না। সম্ভবত আপনিও উপার্জনক্ষম নন। এ অবস্থায় আপনাদের সংসার চলছে কেমন করে, সেটিও বুঝতে পারছি না। সঙ্গীর ক্রমাগত নেতিবাচক আচরণ ও অত্যাচার আপনাকে যে কতটা ভেঙে দিচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছি। নিজের পরিবারের কাছ থেকে কি আপনি কোনো রকম সহায়তা বা মানসিক শক্তি নিতে পারছেন?

এবারে আপনার স্বামীর বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে বলি। যেটুকু উল্লেখ করেছেন, তাতে মনে হচ্ছে, তিনি হয়তো প্যারানয়েড পারসোনালিটি ডিজর্ডার বা প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছেন। আপনাকেও এ দুটো অসুস্থতার নাম উল্লেখ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এগুলোর কারণ, উপসর্গ ও চিকিৎসা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে অনুরোধ করব। এ ধরনের রোগে চিকিৎসা নেওয়ার পরও কতটা সুস্থ হবেন, সে ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে চিকিৎসার আওতায় রেখে তাঁদের কিছুটা হলেও ভালো রাখা সম্ভব। দুঃখজনক হচ্ছে, আমাদের দেশে মানসিক রোগ সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষের ধারণাই সীমিত। আপনার স্বামীর উপসর্গ নিয়ে যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের বেশির ভাগই চিকিৎসা গ্রহণের ব্যাপারে অত্যন্ত অনীহ। তাঁদের মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি ও সচেতনতার অভাবও থাকে। অসুস্থ অবস্থায় তাঁরা একেবারেই বুঝতে পারেন না যে তাঁদের আচরণের কারণে আশপাশের মানুষেরা কতটা কষ্ট পাচ্ছেন বা তাঁদের কী কী ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

এসব রোগ তীব্র আকার ধারণ করলে রোগী অনেক সময় অলীক কল্পনা করতে থাকেন। যেমন মানুষ তাঁদের ক্ষতি করতে চাইছেন। বাস্তবে না থাকলেও তাঁরা কিছু জিনিস দেখতে বা শুনতে পান। দেখা যায়, আশপাশে থাকা মানুষরা যখন তাঁদের আচরণে বিরক্ত হয়ে যান বা রাগ করে কিছু বলেন, তখন রোগীরা তাঁদের শারীরিকভাবেও আঘাত করে বসেন। বাড়ির লোকেদের কষ্ট হলেও এসব রোগীকে একটু সংবেদনশীলতার সঙ্গে দেখতে হবে। কারণ, তাঁরা সচেতনভাবে এসব আচরণ করেন না। মস্তিষ্কের কোষগুলোর মধ্যে যে রাসায়নিক পদার্থ থাকে, সেগুলোর ভারসাম্য নষ্ট হলে আমাদের মুডের তারতম্য হয়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, স্মৃতিশক্তি, ক্ষুধা ও যৌনচাহিদার তারতম্য ঘটে, ব্যাহত হয় মানসিক শান্তি।

আপনি লিখেছেন আপনার স্বামীর মা–বাবার মধ্যে দূরত্ব ছিল, পরিবারে শান্তি ও স্বস্তির পরিবেশ ছিল না। ওনার মা বা বাবার কি কোনো মানসিক অসুস্থতা থাকতে পারে? দেখা যায় যে মানসিক রোগের জন্য শৈশবের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা ও পারিবারিক ইতিহাসও দায়ী।

আপনার স্বামীর মানসিক চিকিৎসাসেবা নেওয়া খুব প্রয়োজন। যেহেতু এ ব্যাপারে তিনি মোটেও আগ্রহী নন, তাই তাঁর পরিবারের সদস্যদের সহায়তা নিয়ে যেভাবেই হোক, ওনাকে হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন। আপনি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট বা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগে মনোচিকিৎসকের কাছে গিয়ে কীভাবে আপনার স্বামীকে চিকিৎসার আওতায় আনা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করুন। স্বামীর পরিবারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সদস্য থাকলে তাঁকেও সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে বসে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং দ্রুত আপনার স্বামীকে চিকিৎসার আওতায় আনার ব্যবস্থা করুন।

মন শক্ত করে এসব কাজ আপনাকে করতে হবে। নিজেও মন আর শরীরের যত্ন নেবেন। কারণ, এ ক্ষেত্রে প্রচুর ধৈর্য ধারণ করতে হবে। আর সেটি করা যদি একেবারেই সম্ভব না হয়, তাহলে আপনার জীবন নিয়ে আপনি কীভাবে সামনে এগোবেন, সে ব্যাপারে নিজের বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।

ঘোষণা

পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। ই–মেইল ঠিকানা: adhuna@prothomalo.com (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ডাক ঠিকানা: প্র অধুনা, প্রথম আলো, ১৯ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA