প্রেমে ব্রেকআপ তীব্রভাবে কষ্ট দিচ্ছে

পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার

মেহতাব খানম

প্রশ্ন: এ বছর আমি এইচএসসি পরীক্ষা দেব। বছরখানেক আগে এক ছেলের সঙ্গে ফেসবুকে আমার পরিচয়, সেখান থেকে প্রেম, তারপর বিচ্ছেদ। এই পুরো প্রক্রিয়া আমার মানসিক অবস্থাকে খুব বাজেভাবে ভেঙে দিয়েছে। আমি বুঝতে পারছি, এই মুহূর্তে আমার কী করা উচিত, আর কী উচিত নয়। তবে কোনোভাবেই মনের সঙ্গে আর যুদ্ধ করতে পারছি না। নিজেকে দেওয়া সব সান্ত্বনা, উৎসাহ আমার শেষ হয়ে গেছে। এখন এমন একটা অবস্থা যে সাধারণ বিষয়ও আমাকে খুব তীব্রভাবে কষ্ট দিচ্ছে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে কোথাও সুযোগ না পাওয়ার তীব্র ভয়ও আমার মধ্যে নতুন হতাশা তৈরি করছে, সব রকম চেষ্টা করেও পুরোনো প্রেমের সম্পর্ক ভুলতে পারছি না। গত মাসগুলোর প্রতিটি রাত অসহ্য বাজেভাবে কেটেছে। এই মুহূর্তে আমার পক্ষে না বাবা–মাকে জানানো সম্ভব হচ্ছে, না সম্ভব হচ্ছে সবটা সহ্য করে নেওয়া। সবচেয়ে বড় কথা, আমি হাজার চেষ্টা করেও কিছুই ভুলতে পারছি না। বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাও এখন আর নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

উত্তর: তোমার চিঠিতে আরও কিছু তথ্য থাকলে ভালো হতো। যেমন ধরো, সম্পর্কের পুরো সময়টিতেই তোমরা কি ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে কথা বলেছ, নাকি তোমাদের দেখাসাক্ষাৎও হয়েছে? সে সময় প্রায়ই কি তোমাদের মধ্যে কথা–কাটাকাটি বা মনোমালিন্য হতো? সম্পর্ক ভেঙে যাওয়াটা কি খুব বাজেভাবে হয়েছে? সেটির অবসান ঘটানোর প্রস্তাবটি কার পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল? এর পর থেকে তুমি কি নিজেকে নাকি ছেলেটিকে বেশি দায়ী মনে করছো?

বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মের আগে থেকেই যেহেতু আমরা মায়ের শরীরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকি, তাই জন্মের পরও প্রত্যেক মানুষ কাছের মানুষদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে চেষ্টা করে। এই নির্ভরশীলতা মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়ে। ছোট্ট একটি শিশুকে যখন আমরা স্নেহের স্পর্শ দিয়ে আদর করি, দেখা যায় ওদের কান্না থেমে যায়, শিশুটির মধ্যে তৈরি হয় নিরাপত্তাবোধ। শৈশবকালীন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পরিবারের অত্যন্ত কাছের মানুষেরা যদি শিশুটিকে অকৃত্রিম স্নেহ-ভালোবাসা এবং নিঃশর্ত গ্রহণযোগ্যতা দিতে সক্ষম হন, তাহলে বড় হওয়ার পর রোমান্টিক সম্পর্কের ওপর আমাদের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা তৈরি হয় না। যদি সম্পর্কটি ঠিকমতো কাজ না করে ভেঙে যায়, তাহলে একেবারে বিধ্বস্ত বা বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ার অনুভূতি থেকে আমরা রক্ষা পাই।

প‌রিবারের খুব নিকট মানুষদের সঙ্গে তুমি হয়তো তেমন ঘনিষ্ঠতা ও নিরাপত্তা বোধ করোনি। যদি তা–ই হতো, তাহলে বিচ্ছেদ ঘটার পর তুমি সেই কঠিন সময়গুলোতে মাকে আস্থা নিয়ে অকপটে নিজের কষ্টের কথাগুলো খুলে বলতে পারতে। তাঁকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদতেও পারতে। মা–ও যদি তোমাকে কোনো দোষারোপ না করে তোমার কষ্টের দোসর হতে পারতেন, তাহলে অনেকেটাই হালকা বোধ করা সম্ভব হতো। মনে হচ্ছে, কিছুটা দূরত্ব আছে বলেই তুমি বাবা-মা, ভাই–বোনকে তেমন ভরসা করতে পারছ না। তোমার ভয় হচ্ছে, তোমাকেই হয়তো এর জন্য অনেক জবাবদিহি করতে হবে। আর তাই তোমাকে কিছুই যেন হয়নি, তেমন ভাব করে জোর করে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে হচ্ছে।

আমার অনুরোধ থাকবে, এই মুহূর্তে নিজেকে সান্ত্বনা বা উৎসাহ দেওয়ার প্রচেষ্টাটি সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়ে নিজেকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসতে চেষ্টা করো। একটি মানুষ তোমাকে ছেড়ে গেছে বলে মোটেও তুমি মূল্যহীন হয়ে যাওনি, এই কথাটি নিজেকে মনে করাতে থাকো বারবার। কঠিন ও কষ্টকর অভিজ্ঞতাটি তোমাকে কী কী ভাবাল, সেগুলো কোথাও লিখে রাখতে পারো; তবে তা শুধু নিজের জন্য, অন্য কারও নজরে যাতে না পড়ে। ভবিষ্যতের কথা আমরা যেহেতু কেউ আগে থেকে জানতে পারি না, তাই সামনের দিনের ভাবনাগুলোকে একেবারে পরিহার করে প্রতিদিনের সূর্যকে স্বাগত জানাও। অন্তত সেই দিনটিকে ভালোভাবে কাটানোর সংকল্প নিয়ে দিনগুলো কাটাতে চেষ্টা করো। জোর করে কোনোকিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলে সেটি আরও বেশি করে মনে পড়ে। তাই সেই চেষ্টা থেকেও নিজেকে বিরত রাখো।