আমাদের সমাজে নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের পর কনেদের ঠিকানা বদলে যায়। অর্থাৎ কনেকে মা-বাবার বাড়ি থেকে যেতে হয় বরের বাড়িতে। তবে বরের ক্ষেত্রে ঠিকানা বদলের ঘটনা তুলনামূলক কম ঘটলেও জীবনযাপন কিন্তু সবারই বদলায়। একলা জীবনের অবসান, নতুনের সূচনা; তাই শুরু থেকেই দায়িত্বশীল আচরণ করা জরুরি। নতুন বর বা জামাইয়ের বেলায় স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির কাছে শুরুর সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ সময়ের ‘ইমেজ’টাই কিন্তু স্থায়ী হয়ে যায়। বিয়ের পর নতুন পরিবেশে কনেকে যেমন মানিয়ে নিতে হয়, নতুন বরকেও খাপ খাওয়াতে হয় পরিবর্তনের সঙ্গে।
নতুন স্বামী বা জামাই হিসেবে আপনি আপনার স্ত্রী এবং শ্বশুরবাড়ির কাছে দারুণ আদর-আপ্যায়ন পাবেন নিঃসন্দেহে। তবে তাঁদের প্রতি আপনারও কিছু দায়িত্ব আছে। নতুন পরিবেশে স্ত্রীর জীবনের অনেক কিছুই বদলে যায়। তাঁর দৈনন্দিন ছোটখাটো সুবিধা-অসুবিধাগুলো জেনে নিন। তাঁর হয়তো সকালে কফি খাওয়ার অভ্যাস। এদিকে আপনার বাসায় কফির চল নেই; চা খাওয়া হয়, সেটিও কেবল বিকেলে। আপনার অবশ্যই উচিত তাঁর জন্য কফির ব্যবস্থা রাখা। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি নিজ হাতে তাঁর সকালের কফিটা বানিয়ে দেন। স্ত্রীর বন্ধু হয়ে উঠুন শুরু থেকেই। তাঁর মতামত জানতে চান যেকোনো বিষয়ে; তবেই না তিনি সহজে আপনার পরিবারের একজন হয়ে উঠবেন। আবার ধরা যাক, আপনার পরিবারের পক্ষ থেকে নতুন বউকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হলো। এ ক্ষেত্রে আপনার দায়িত্ব হলো, তিনি সেই কাজে স্বচ্ছন্দ কি না, তা জেনে নেওয়া এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তাঁকে সহযোগিতা করা। সেটি রান্নাঘরের কাজ হলেও পিছপা হবেন না। আপনার মনের কোণে কোথাও যদি এমন ভাবনা কাজ করে, ‘আমি পুরুষ, এসব আমার কাজ নয়, বিয়ের পর বউই তো এসব করবে’, তাহলে জেনে রাখুন, আপনি ভুল করছেন। আপনার যদি আগে থেকে ঘরের কাজের অভ্যাস না-ও থাকে, তাহলে বিয়ের পর এসব কাজ শিখে নিন। কারণ, আপনি এখন ‘সংসারী’। এমনকি শ্বশুরবাড়ির প্রয়োজনে তাঁদের পাশে দাঁড়ানোও এখন থেকে আপনার দায়িত্ব।
স্ত্রীর ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন না। তাঁর স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টাও করবেন না। আবার স্ত্রীকে চাকরি করার ‘অনুমতি দিচ্ছেন’ বলে নিজেকে ‘মহান পুরুষ’ হিসেবে জাহির করতেও যাবেন না। স্ত্রী চাকরি করবেন কি করবেন না, রোজগারের টাকা কোথায় ব্যয় করবেন না করবেন, এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাঁরই। স্ত্রী চাইলে আপনি পরামর্শ দিতে পারেন, তবে সিদ্ধান্ত ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্ব আপনার নয়। শুরু থেকেই সংবেদনশীল বিষয়ে মতামত দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। বরং খেয়াল রাখুন, নতুন বাড়িতে কোনো কিছু তাঁর খারাপ লাগছে কি না। আপনি যে তাঁর প্রতি যত্নশীল, এটা প্রকাশ করুন। তিনি কখন বাবার বাড়ি যাবেন, কখন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন, কখন বের হবেন, কখন ফিরবেন—এসব নিয়ে আপনার বা আপনার পরিবারের ইচ্ছা কিংবা অলিখিত কোনো নিয়ম তাঁর ওপর চাপিয়ে দেবেন না।
আপনার বন্ধুর বিয়েতে হয়তো বন্ধুটি বাহারি উপহার পেয়েছেন, বিয়ের পর নতুন জামাই হিসেবে তাঁকে অনেক নিমন্ত্রণেও যেতে দেখেছেন। আপনার ক্ষেত্রে হয়তো তেমনটা হলো না। এসব নিয়ে নেতিবাচক ভাবনার স্থান দেবেন না মনে। কথাপ্রসঙ্গেও স্ত্রীকে এসব নিয়ে কিছু বলবেন না কখনো। স্ত্রী যদি একভাবে সাজানো জিনিস অন্যভাবে সাজাতে চান, সেটিতেও বাধা দেবেন না। স্ত্রী যেমন আপনার কিছু বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছেন, আপনিও সেভাবে স্ত্রীর কিছু বিষয়ের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস করুন। আপনার পরিবারের অনেকের অনেক আবদার থাকতে পারে আপনার স্ত্রীর কাছে। এসব ক্ষেত্রে আপনার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনার স্ত্রী সেসব আবদারের সবই যে আনন্দের সঙ্গে মেটাতে পারবেন, এমনটা ধরে নেবেন না। ভুলে যাবেন না, তাঁরও কিছু নিজস্বতা আছে। পরিবারের অন্যদেরও সহজভাবে বুঝিয়ে দিন বিষয়টা। যদি মনে করেন পরিবারকে বুঝিয়ে কাজ হবে না, তাহলে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে সেই সমস্যার সমাধান করুন। সে ক্ষেত্রে অবশ্য স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে পারেন।
স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটান। কথা বলুন। তাঁকে জানুন। নিজের সম্পর্কে জানান। মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গে ঘুরতে যেতে পারেন। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতেও সময় দিন স্ত্রীকে। পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের সঙ্গে নতুন বউয়ের মনোমালিন্য হতে পারে, এমন পরিস্থিতিতে আপনি কারও পক্ষ নেবেন না। সহজভাবে সমাধান করতে চেষ্টা করুন। পরিবারের কেউ কেউ অবশ্য তাঁদের পক্ষ না নেওয়ার কারণে আপনাকে ‘স্ত্রৈণ’ উপাধি দিয়ে বসতে পারেন, কেউ আবার অভিমানও করতে পারেন। এসব বিষয়ও সামলে নিন সাহসের সঙ্গে। কোনো অবস্থাতেই কাউকে দোষারোপ করবেন না। মেজাজ দেখাবেন না। আপনার বন্ধুদের কেউ আপনার স্ত্রীর প্রতি নেতিবাচক আচরণ করলে সে ক্ষেত্রেও এসব বিষয় খেয়াল রাখুন।
আপনি শ্বশুরবাড়ি গেলে আপনাকে সব সময় মাথায় তুলে রাখবে, এই প্রত্যাশা রাখবেন না। বরং আপনি তাদের জন্য কী করছেন, সেটা নিজের মনকেই জিজ্ঞাসা করুন। শ্বশুর-শাশুড়ি যাতে নিজেদের পরিবারের সব কথা মন খুলে আপনার কাছে বলতে পারেন, আপনার পরামর্শ নিতে পারেন, এমন পরিবেশ তৈরি করুন। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে খাওয়া শেষে প্লেটটা কেউ নিয়ে যাবে, এই অপেক্ষায় থাকবেন না, বরং প্লেটটা নিজেই ধুয়ে ফেলুন। শুরু থেকেই আপনি যদি এই অভ্যাস করে নেন, সেখানে আপনার কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। আপনি এই কাজ করতে গেলে অবশ্য আপনার শ্বশুরবাড়ির অনেক সদস্যই সেটাতে রাজি হবেন না, তারপরও আপনি করুন। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী তার পরিবারের কাছে বিষয়টা সহজ করে দিতে পারেন। আপনার যদি শ্যালক-শ্যালিকা থাকে, তাদের সঙ্গে মিশুন বন্ধুর মতো। তবে শ্যালিকাদের সঙ্গে এমন কোনো আচরণ করবেন না, যা আপনি নিজের বোনের সঙ্গে করতে পারবেন না। শ্বশুর-শাশুড়ির কোনো কাজে আপনার সাহায্য করার থাকলে সেটাতেও নিজ থেকে এগিয়ে যান। পরিবারের অনেক সংকটের কথা বেশির ভাগ পরিবার জামাইকে জানতে দিতে চায় না। আপনার স্ত্রীর কাছ থেকে এমন কোনো সংকটের কথা শুনলে নিজ থেকে তাঁদের পাশে দাঁড়ান। এতে আপনার স্ত্রীও কিন্তু আপনার ওপর বাড়তি আস্থা রাখবেন। শ্বশুরবাড়িতে খাবার টেবিলে হয়তো নিয়ম করে আপনাকে তিন বেলা মাছের মাথা, রানের পিস দিচ্ছে আর আপনিও খাচ্ছেন। সেটা না করে খাবার টেবিলে থাকা পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ভাগ করে দিতে পারেন। অনেকে নতুন জামাইকে সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে সব বেলা পোলাও-কোরমা খাওয়াতে চান, সে ক্ষেত্রে আপনিই বরং ভুল ভাঙাতে এগিয়ে আসুন। বলুন, ভাত-মাছের মতো নিয়মিত খাবারেই আপনি স্বচ্ছন্দ।
সূত্র: ম্যারেজ ডটকম, হেল্প গাইড ও ফিজিওলজি টুডে