আজ মে মাসের দ্বিতীয় রোববার, মা দিবস। বিশেষ এই দিন উপলক্ষে আমরা মাকে নিয়ে লেখা আহ্বান করেছিলাম পাঠকের কাছে। পাঠক লিখেছেন তাঁর বেড়ে ওঠার পেছনে মায়ের অনুপ্রেরণার গল্প।
মামণি আমার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ, অবলম্বন, শক্তির আধার। তাঁর নাম সুফিয়া পারভিন। এখন সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। খুব অল্প বয়সেই সামাজিক গোঁড়ামি, আর্থিক অনটনসহ নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ থানা থেকে নার্সিং পড়তে রংপুরে আসেন তিনি।
নার্সিং পাস করার পর সরকারি চাকরিতে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়োগ পান। পারিবারিক কোনো সাহায্য ছাড়াই মামণিকে সেই পাহাড়ি জায়গায় একা থাকতে হয়েছে। আমার মামণি আমার মা-বাবা উভয়ের দায়িত্ব একাই পালন করেছেন। পারিবারিক কিছু সমস্যার কারণে ছোটবেলা থেকে বাবাকে তেমন পাইনি। তখন থেকে আমার জীবনের জ্বলজ্বলে তারা—আমার মামণি। একজন একা মায়ের (সিঙ্গেল মাদার) ছেলে হিসেবে জীবনসংগ্রামের উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে পথ দেখিয়েছেন তিনি। তবে সমস্যাও ছিল। প্রচলিত পারিবারিক কাঠামোর মতো না হওয়ায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বন্ধুদের বাবা-মায়ের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েছি। আত্মীয়রা সমালোচনা করেছেন, প্রতিবেশী অনেকেই নীচ চোখে দেখেছেন।
মামণির সঙ্গে ভবিষ্যতের দিকে পা রেখেছিলাম। মামণি তাঁর জীবনের সব সময়, শ্রম, ভালোবাসা আমার জন্য নিংড়ে দিয়েছেন। দীর্ঘ নার্সিং ডিউটির পর, রাতে তাঁর হাতের স্পর্শ আর ঘুমপাড়ানি গান আমার সারা দিনের সব অপমান, খোঁটা ও কষ্টকে উপসম করত।
মনে পড়ে, আমার বয়স যখন মাত্র ১২ বছর, মামণি একবার লক্ষ্মীপুরে বদলি হন। আর্থিক সংকট ও নিরাপত্তার কারণে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত একাই আমাকে রংপুরে থাকতে হয়েছে। আমার সেই সব দিন–রাত নীরবতায় পূর্ণ ছিল। ঘরের এক কোনায় বসে থাকতাম সারা রাত। আর ভাবতাম, জীবন নিয়ে, জীবনের রূঢ় সব বাস্তবতা নিয়ে। আগামীকাল কী করব, কীভাবে রান্না করব, বাসার সব কাজ একা কীভাবে সামলাব, সবকিছুর পরে কীভাবে লেখাপড়া ঠিক রাখব! এভাবে এক বছর কেটেছে। বুঝতে পারছিলাম, আমার জন্য জীবন আর বাস্তবতা বদলের একমাত্র চাবিকাঠি হলো পড়াশোনা। সামনে আসা প্রতিটা সুযোগ কাজে লাগাতে পারলেই পরিবর্তন আনতে পারব।
ছোটবেলা থেকেই এই মহাবিশ্ব নিয়ে আমি খুব প্রশ্ন করতাম। আর্থিক সমস্যার কারণে অনেক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে না পারলেও পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিত নিয়ে সব সময় পড়ে থাকতাম। নটর ডেম কলেজে পড়ার সময় জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে আগ্রহ বাড়ে। ২০২৩ সালের আন্তর্জাতিক যুব গণিত প্রতিযোগিতা ও আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা প্রতিযোগিতায় সারা বিশ্বের মধ্যে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় হই। আর এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক প্রোগ্রামে ‘প্রেসিডেনশিয়াল মেরিট’ বৃত্তি পেয়েছি।
আজ যে অবস্থানে পৌঁছেছি, এর পেছনে সব অবদান আমার মামণির। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও কষ্টের ফলেই যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তব হতে যাচ্ছে। পরিশেষে মামণিকে একটা কথাই বলতে চাই, ‘ভালোবাসি তোমাকে। তোমার জীবনের প্রতিটি কষ্ট তোমার ছেলে একদিন সার্থক করবে ইনশা আল্লাহ। ভালোবাসি, মামণি।’
লেখক: সুফিয়ান মুরাদ প্রতীক, কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগ, টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র