বিয়ের পর তো বদলে গেছ—এই কথা কি আপনাকেও শুনতে হয়?

পুরুষ হোক বা নারী, বিয়ের পর একটা কথা শুনতেই হয়—ও তো আর আগের মতো নেই। কী এমন ঘটে যে ব্যাচেলর থেকে বিবাহিত তকমা লাগার পরই ধেয়ে আসে এই অভিযোগের তির। বন্ধুদের অভিযোগ, এখন ডাকলে তোকে পাওয়া যায় না। আবার ঘরে ফিরলে স্ত্রী স্বামীকে আর স্বামী স্ত্রীকে একই অনুযোগ করে। কেন এমন হয়, ঘর–বাহির দুই দিকই সামলে নিতে কী করার আছে

‘কই তুমি? থাকো, ওদের সঙ্গেই থাকো।’ মডেল: মেহেদি যুবরাজ, সাব্বির খান ও রাকিব আহমেদ
ছবি: কবির হোসেন

এ কথা তো সত্য, বিয়ের পর একটা মানুষের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আসে, না চাইলেও আসে। যদি না আসে, তাহলে বুঝতে হবে, আপনি কোনো এক পক্ষের প্রতি সুবিচার করছেন না। তাই বলে এক পক্ষের দিকে ঝুঁকে, অন্য সম্পর্কে চিড় ধরানো যাবে না। কারণ, প্রতিটি সম্পর্কই গড়ে ওঠে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঠিকঠাক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে। আপনার হয়তো কয়েকজন ভালো বন্ধু আছে, যাদের সঙ্গে আপনি নিয়মিত সময় কাটান। বিকেলে অফিস থেকে ফিরে সোজা চলে যান বন্ধুদের আড্ডায়, সেখান থেকে বাসায় ফেরেন গভীর রাতে। কিন্তু বিয়ের পর সেই রুটিন স্বাভাবিকভাবেই এক থাকবে না। নতুন একটি সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পর সেখানেও সময় দিতে হবে। তবে স্ত্রী বা স্বামীকে সময় দিতে গিয়ে যেন এমন না হয়, বন্ধুদের ফোনও ধরছেন না। এই সময়ে আপনার আন্তরিকতাই বন্ধু বা সঙ্গীকে আশ্বস্ত করতে পারে, কেউই আপনার জীবনে কম গুরুত্বপূর্ণ নন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানজির আহমেদ বলেন, ‘ছেলেদের ক্ষেত্রে একটা বিষয় বেশি দেখা যায়, হয়তো একজনের বিয়ের কথাবার্তা চলছে, তখনই বাকি বন্ধুরা মিলে তাকে টিজ করতে থাকে “বিয়ে করছ! আর তো পাওয়া যাবে না। ডুমুরের ফুল হয়ে উঠবে।” এমন টিজের কারণে অনেকে আরও বেশি সতর্ক থেকে বিয়ের পর এক দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে। আর এই ঝুঁকে পড়ার কারণেই অন্যদিকের সম্পর্কটা খারাপ হতে থাকে। তাই বিয়ের পর দুই দিকেই ভারসাম্য রেখে চলাটা খুব জরুরি।’

হানিমুন পর্বে বিশেষ সতর্কতা

বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমায় সঙ্গীকে একান্ত সময় দেওয়া জরুরি। মডেল: অভিনেতা দম্পতি টয়া ও শাওন

আপনি বিয়ের পর যখন একটা নতুন মানুষের সঙ্গে জড়াচ্ছেন, তাকে অনেকটা সময় দেবেন, সেটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে শুরুর দিকে (মধুচন্দ্রিমা পর্ব) সঙ্গীকে আপনার সময় দিতেই হবে। এতে সেই মানুষটিকে আপনি যেমন বুঝতে পারবেন, আপনাকেও তাঁর বোঝা সহজ হবে। আর এই সময়ে আপনি যে বন্ধুদের খুব বেশি সময় দিতে পারছেন না, সেটা তাদের বুঝিয়ে বলতে পারেন। দেখা করা সম্ভব না হলে ফোনে, ভিডিও কলে বন্ধুদের সঙ্গে সুন্দর সময়ের কিছুটা ভাগ করে নিতে পারেন। এতে আপনাকে হারিয়ে ফেলার ভয় বন্ধুদের ভেতর থেকে উবে যাবে। বরং বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনার সময় আপনার জীবনসঙ্গীর নানা বিষয় তাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারেন। একটা সময় পরে সঙ্গীকেও বন্ধুদের সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেন। এতে সম্পর্কটা সহজ হবে। বন্ধুরা যে আপনার কাছে এখনো সমান গুরুত্বপূর্ণ, সেটা যেন তারা আপনার আচরণে বুঝতে পারেন। আর আপনার সঙ্গী (স্বামী বা স্ত্রী) এই সময়ে যাতে একাকিত্বে না ভোগেন, সেদিকে বিশেষ যত্নবান হতে হবে।

সঙ্গীর সঙ্গে বন্ধন মজবুত করুন

‘লোকে কী বলবে’ ভেবে সঙ্গীকে কম সময় দিলে পরবর্তীকালে পরিবারের বন্ধন আলগা হয়ে যেতে পারে। ছবিতে অভিনয়শিল্পী শাওন ও টয়া

সাধারণত আমাদের সমাজে বিয়ের পর স্ত্রী তাঁর চেনা পরিবেশ ছেড়ে একটা নতুন বাড়িতে আসেন। তাই নতুন পরিবেশে তাঁকে মানিয়ে নিতে স্বামীর বিশেষ ভূমিকা রাখতে হয়। এমনিতেই তাই স্ত্রীকে বেশি সময় দিতে হবে। আজকাল আবার শহুরে জীবনে দুজনেই নিজেদের বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে ওঠেন। সে ক্ষেত্রেও দুজনের মধ্যে বন্ধন জোরালো করতে বেশি বেশি সময় কাটানোর দরকার পড়ে। তাই বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আগের মতো সময় যে আপনি দিতে পারবেন না, এটাই তো স্বাভাবিক। এ নিয়ে নিজের মধ্যে কোনো দ্বিধা রাখা যাবে না। ‘লোকে কী বলবে’ ভেবে সঙ্গীকে কম সময় দিলে পরবর্তীকালে পরিবারের বন্ধন আলগা হয়ে যেতে পারে। স্বামী–স্ত্রী দুজনই যদি কর্মজীবী হয়ে থাকেন, তাহলে সারা দিন নিজেদের কাজ নিয়েই কেটে যায়। তাই বাসায় ফিরে দুজনের একান্ত সময় কাটানোর বিকল্প নেই।

বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার সময় রাখুন

আগের মতো সময় আপনি হয়তো বন্ধুদের দিতে পারবেন না, তবে কিছুটা হলেও তাদের সময় দিতে চেষ্টা করুন। দীর্ঘদিনের যে বন্ধুত্ব, সেটা একেবারে গুটিয়ে নিলে সবার কাছেই দৃষ্টিকটু লাগবে। বাকিদের সঙ্গে এতে দূরত্বও বাড়তে পারে। তাই আগের মতো না পারলেও সপ্তাহের একটা সময় বন্ধুদের জন্য বরাদ্দ রাখুন। আর এই সময়টা যে আপনি বন্ধুদের সঙ্গে কাটাবেন, সেটা আপনার সঙ্গীকেও জানিয়ে রাখুন। প্রয়োজনে দুজনে আলোচনার মাধ্যমে একটা সময় নির্ধারণ করে নিতে পারেন। যদি দুজনের মতামতের ভিত্তিতেই বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে গিয়ে থাকেন, তখন আরেকজনের বারবার ফোন করে ফেরার তাগাদা দেওয়াটা বন্ধুরা ভালো চোখে না–ও নিতে পারেন। তবে সময়টা যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি।

যেখানে আছেন, পূর্ণ মনোযোগে থাকুন

দুজনে খেতে বসে মুঠোফোনে সময় কাটানো ঠিক না। মডেল: লাবণ্য ও তূর্য্য

আপনি হয়তো অফিস শেষে বাসায় ফিরেছেন। হাত–মুখ ধুয়ে আবার নিজের মতো ফোনে আড্ডা শুরু করলেন। এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা ফোনেই কেটে যাচ্ছে। এতে আপনার সঙ্গী যে বিরক্ত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এমন ঘটনা নিয়মিত ঘটতে থাকলে দাম্পত্যে এর প্রভাব পড়বে। আবার বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও আড্ডা দিতে গেলেন, কিন্তু একটু পর পর ফোন করে অকারণে আপনার স্ত্রী বা স্বামীর অবস্থান জানতে চাইলেন, সেটাও ঠিক না। যখন যেখানে থাকেন না কেন, সেখানেই পূর্ণ মনোযোগ রাখুন। আবার স্ত্রীকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় বা সিনেমা দেখতে গিয়ে যদি ফোনে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান, সেটাও আপনার দাম্পত্য সম্পর্কে খারাপ প্রভাব ফেলবে।

দুটি সম্পর্কেই সময় দিন

বন্ধুদের আড্ডায় যেমন থাকবেন, পরিবারকেও গুরুত্ব দিতে হবে। মডেল: রিয়াদ ও রাব্বি

বন্ধুত্ব বা বিয়ে—দুটি সম্পর্কই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হতে থাকে। একটা সময় খেয়াল করবেন আপনার কোনো বন্ধুই আর অবিবাহিত নেই। ঠিক এই সময়ে সবাই নিজ নিজ পরিবারের বাস্তবতা বুঝতে পারে আর সম্পর্কগুলো তখন আরও সহজ হয়ে যায়। এই সময়ে বরং বন্ধুদের সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে, বন্ধুর সঙ্গে তার সঙ্গীরাও বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। এতে আড্ডার পরিবেশও বদলে যায়। যখন বন্ধুরা মিলে বেড়াতে বা খেতে যাওয়ার পরিকল্পনা করবেন, সেখানে নিজেদের অজান্তেই এই সময়ে আপনাদের সঙ্গীরা যুক্ত হয়ে যাবে। তাই কোনোটাকেই পুরোপুরি বাদ না দিয়ে, সময় দিন। সম্পর্কগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সহজ হবে।