সাত নম্বর বাড়িটার নাম সমতা। সেই বাড়িতে সদ্য জন্ম নেওয়া এক শিশু এসেছে। আমরা যখন শিশুটিকে দেখতে গেছি, তখন তার বয়স ছয় দিন। কথা বলতেই পাঁট বছরের মানিক এসেই হুঁশিয়ারি দিল, ‘আস্তে কথা বলো তোমরা। বাবু ঘুমাচ্ছে।’ পাঁচ দিন হলো হাসপাতালের চিকিৎসকের মাধ্যমে সে এই বাড়িতে এসেছে।
জানা গেল, রাতে একটুও বিরক্ত করে না। দিব্যি খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, চোখ মেলেই দেখতে পাচ্ছে ছয় বড় ভাই–বোনদের কাউকে না কাউকে। প্রথম ২৪ ঘণ্টা ছিল হাসপাতালে। তাঁর সত্যিকারের মা–বাবা বা পরিচয় সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। নাম আবদুর রহমান আবির। তাঁর ‘মা’য়ের নাম মারুফা পারভীন। ওই বাড়ির আরও সাত শিশুর মা মারুফা। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ‘মা’ পদে চাকরি করছেন মারুফা। ঘরে নতুন শিশু আসায় এই বাড়িতে এখন একজন ‘খালা’ও নিযুক্ত আছেন। বলছি শিশুপল্লির কথা।
১১ মে রাজধানীর শ্যামলীর শিশুপল্লির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে হেঁটে হেঁটে চারপাশটা দেখছি। এমন সময় মিতু নামের একটা মেয়ে জানাল ৭ নম্বর বাড়ির নতুন সদস্যের কথা। মিতুও শিশুপল্লির সন্তান। তিনি এখন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। বিবিএ শেষ করে বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে পড়তে যাবেন—এমনটাই পরিকল্পনা করেছেন। হোস্টেলে থাকেন। বেড়াতে এসেছেন ‘বাপের বাড়ি’। যে বাপের বাড়িতে কেবল মায়েরাই থাকেন। শিশুপল্লিতে বড় হয়ে অনেকেই এখন দেশের বাইরে। অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। চাকরি করছেন দেশের নানা প্রতিষ্ঠানে।
শ্যামলী শিশুপল্লিতে মোট ১৫টি বাড়ি। দোতলা ডুপ্লেক্স বাড়িগুলো লাল ইটের। কিছু আছে তিনতলা। আছে অডিটোরিয়াম। খেলার মাঠ। বাড়িগুলো তাদের ভাষায় ‘ফ্যামিলি হাউস’। মমতা, সমতা, শ্যামলী, কাকলী, সোনালী, রূপালী, পূবালী, মায়াবী—এ রকম হরেক নাম। অনেকটা কলোনির মতো। আক্ষরিক অর্থেই ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা।
রাজধানীর ব্যস্ততম এক সড়কের পাশেই যে এ রকম এক টুকরা আধুনিক গ্রামের খোঁজ মিলবে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ১৫টি বাড়িতে থাকেন ১৫ জন মা। এই মায়েদের সহযোগিতায় আছেন ছয়জন খালা। প্রতিটি মায়ের অধীন আছেন ছয় থেকে আটটি শিশু। তারা সবাই অনাথ, সুবিধাবঞ্চিত পরিবার থেকে এসেছে। বড় হয়ে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে শিশুপল্লি।
চার বছরের মানিক জানাল, সে আর রিফাত দুই ভাই। তারা স্কুলে যায়। চকলেট খায়। খেলে। ঘুমায়। আর ‘মাইর–পিট’ও করে মাঝেমধ্যে। গাছ লাগায়। ‘মা’ মারুফা আক্তার জানালেন, ‘মানিক আর রিফাত আসলে আপন ভাই নয়। তবে একই ঘরের, তাই নিজেদের আপন ভাইবোন মনে করে সবাই। বুঝতে পারে না যে ওরা আসলে আপন ভাই নয়।’
মানিক আর রিফাতের মতো এই শিশুপল্লির মায়েরাও আসলে বুঝতে পারেন না যে এই সন্তানেরা তাঁদের নিজেদের সন্তান নয়।
২০ বছর ধরে শ্যামলী শিশুপল্লিতে আছেন ফাতেমা বেগম। এর আগে বগুড়ায় ‘খালা’ পদে চাকরি করেছেন চার বছর। ২০ বছরে তাঁর ৩০টি সন্তান। তাঁদের অনেকেই আবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। একজন অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করছেন। একজন জাপানে শিক্ষকতা করেন। আরেকজন চীনে বৃত্তি নিয়ে পড়তে গেছেন। কেউ কেউ বিয়েশাদি করে থিতু হয়েছেন। সন্তানসন্ততি হয়েছে। ফাতেমা সেই শিশুদের নানি। মায়ের সঙ্গে সন্তানের যেমন যোগাযোগ থাকে, তেমনই ফাতেমার সঙ্গেও তাঁর এই সন্তানেরা যোগাযোগ রাখেন।
শিশুপল্লির এই ৩০ সন্তানের বাইরে ফাতেমার নিজের দুই কন্যা আছে। তাঁরা থাকেন ফাতেমার ভাই–ভাবির কাছে। দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। ফাতেমা বলেন, ‘এটাকে আমি কোনো দিন চাকরি মনে করিনি। চাকরি মনে করার সুযোগ কোথায়? এই সন্তানেরা আমাকে মা ডাকে, মায়ের মতো সম্মান করে, ভালোবাসে জন্মদিনে চোখ বেঁধে ধরে এনে সারপ্রাইজ দেয়। ঈদে, মা দিবসে উপহার দেয়। আমি ৩২ সন্তানের মা। এটাই আমার পরিচয়।’
নুসরাত জাহান দিশাকে তিন মাস বয়স থেকে পালছেন ফাতেমা। দিশার জন্মগতভাবে টনসিলের সমস্যা ছিল। প্রতি মাসেই হাসপাতালে দৌড়াতে হতো। ৫ বছর বয়সে তাঁর টনসিল অপারেশন হয়। ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে ফাতেমাকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! শুধু বলেছিল ‘ওরা আমাকে মেরেছে’। ফাতেমাও আটকাতে পারেননি চোখের পানি। ১১ বছরের দিশা এখন ক্লাস সিক্সে! ভালো ছাত্রী হিসেবে নামডাক আছে।
আরেক ‘মা’ আঞ্জুয়ারা বেগম শিশুপল্লিতে আছেন ১১ বছর। তিনি এখন যে বাড়ির ‘মা’, তাঁর আগে তাঁর নানি ছিলেন একই বাড়ির ‘মা’। আঞ্জুয়ারা বললেন, ‘এইখানে আসলে আসার দরজা খোলা। কিন্তু যাওয়ার কোনো দরজা নেই। কেননা, শিশুদের মায়ার চেয়ে বড় বন্ধন আর হয়? মা কি তাঁর সন্তানদের ফেলে কোথাও যেতে পারেন? আমার এখন মনে হয়, এইটা আমার “স্বামীর ঘর”। নিজের সংসার। নিজের সন্তান। নিজের সবকিছু। আর বাপের বাড়িতে বেড়াতে যাই। তবে ওখানে গিয়েও মনটা এখানে ফিরে আসার জন্য ছটফট করে। আসলে কী, রক্তের সম্পর্কের চেয়েও আত্মার সম্পর্ক বড় আর কেবল জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না, জন্ম না দিয়েও মা হওয়া যায়। আমি নিজেই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।’
আঞ্জুয়ারার সবচেয়ে ছোট সন্তানের নাম মুস্তফা। সে যখন এসেছিল, তখন তাঁর বয়স ছিল ৯ মাস। অপুষ্টিতে ভোগায় বসতেও পারত না। এখন বয়স সাড়ে ৩ বছর। দিব্যি ছোটাছুটি করছে। দৌড়ে এসে আঞ্জুমানের কোলে চড়ে বসল। এই ‘মা’য়ের হাতে ছাড়া সে খাবে না। এতক্ষণ (শনিবার বেলা ৩টা পর্যন্ত) সাংবাদিকেরা এই মায়েদের ছবি তুলছিলেন, সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন বলে মুস্তফারও নাওয়া–খাওয়া হয়নি।
মুস্তফাকে কোলে নিয়ে আঞ্জুয়ারা বললেন, ‘আমি তো লুকিয়ে বাড়িতে যাই। খুব ভোরে বের হয়ে যাই। ওরা সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে। তবে আমি বিছানা থেকে উঠলেই মুস্তফা কীভাবে যেন টের পেয়ে যায়। কান্নাকাটি শুরু করে। আমি যতবার বাড়িতে গেছি, প্রত্যেকবার অসুস্থ হয়েছে মুস্তফা। আর ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ধরে কী কী হলো এই কয় দিনে সব গড়গড় করে বলতে থাকে।’ শুনে অন্যরা একটু টিপ্পনী কেটে বলে, ‘সব মনেও থাকে, বাবারে বাবা!’
শেখ মুনতাকিম প্রত্যয় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ক্রিকেট, ফুটবল খেলার প্রতি ঝোঁকটা বেশি। বড় হয়ে সে ক্রিকেটার হতে চায়। তবে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া ‘অত সহজ নয়’ বলে সে ডাক্তারি পেশাটাকে বিকল্প হিসেবে রেখেছে। স্কুলে (এসওএস হারম্যান মেইনার কলেজ, ঢাকা। এখানে স্কুল শাখাও রয়েছে। এই শিশুপল্লির শিক্ষার্থীরা এই স্কুল থেকেই এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দেয়) তাঁর রোল ৫৭। কেননা, নামের বানানের ক্রমানুসারে রোল নম্বর সাজানো। পরীক্ষার ফলের সঙ্গে রোলের কোন সম্পর্ক নেই।
জাকিয়া সুলতানা ফাইজা নবম শ্রেণিতে পড়ে। ওর আবার জ্যাক আর চেরি নামের দুটো বিড়াল আছে। ৬ বছরের রাজ বৈদ্য হতে চায় ‘আর্মি অফিসার’। এখন থেকেই তাঁর চুলের ছাঁট, হাঁটাচলা, কথা বলার স্টাইলে সেই হাবভাব বজায় রাখে। এই বয়সেই সে নাকি ফিটনেস ঠিক রাখার জন্য নিয়ম করে ব্যায়ামও করে। এদিকে মোহাম্মদ ইরফান হতে চায় শেফ। আর সাদিয়া তাঁর ‘মা’ মারিফা পারভীনের মতোই শিশুপল্লির ‘মা’ হতে চায়। সে কোনো দিন এই পল্লি ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না।
ছেলেরা ১৪ আর মেয়েরা ১৮ বছর পর্যন্ত থাকতে পারে এই শিশুপল্লিতে। তারপর তারা চলে যায় বিশেষ হোস্টেলে। সেখান থেকেই চালিয়ে নেয় লেখাপড়া। শিশুপল্লি বিভিন্ন সময়ে ‘মা’ ও ‘খালা’ পদে নিয়োগ নেয়। ২৪ থেকে ৩৫ বছরের বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত বা অবিবাহিতা ও ন্যূনতম এসএসসি পাস হলেই এই পদে আবেদন করতে পারেন।
বাংলাদেশের ছয়টি জায়গায় রয়েছে এই শিশুপল্লি। সব মিলিয়ে রয়েছে ৮১টা ‘ফ্যামিলি হাউস’। শিশুর সংখ্যা ৯৯৭ জন।
শূন্য থেকে ছয় বছরের অনাথ, অসচ্ছল পরিবারের শিশুরা এখানে ভর্তি হতে পারে। বাচ্চার আত্মীয় বা অন্য কেউ শিশুপল্লিতে এসে আবেদন করতে পারেন। এরপর তদন্তসাপেক্ষে শিশুটিকে ভর্তি করে নেওয়া হয়। শিশুদের একটা বড় অংশ শিশুপল্লিতে আসে সমাজসেবা অধিদপ্তর আর হাসপাতালের মধ্য দিয়ে। সংস্থাটি পরিচালিত হয় হারম্যান মেইনারের তহবিল, বিশ্বব্যাপী অসংখ্য বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীর সহায়তায়। কেউ সহায়তা করতে চাইলে শিশুপল্লির নির্ধারিত ফরম পূরণ করে করতে পারেন।
চাইলে আপনিও শিশুপল্লির শিশুদের দায়িত্ব নিতে পারেন। এককালীন দান বা সম্পত্তি উইলের মাধ্যমে দিতে পারেন শিশুপল্লিকে। এ ছাড়া একজন শিশুর বার্ষিক স্পন্সর বাবদ মাসিক ১ হাজার টাকা করে বার্ষিক ১২ হাজার টাকা, শিশু সহায়তার জন্য মাসিক ৫০০ টাকা করে বার্ষিক ৬ হাজার টাকা এবং শিশুপল্লির বন্ধু হিসেবে মাসিক ২০০ টাকা করে বার্ষিক ২ হাজার ৪০০ টাকা প্রদান করে যে কেউ-ই যুক্ত হতে পারেন এই উদ্যোগের সঙ্গে। জাকাতও দিতে পারেন এই প্রতিষ্ঠানকে।
এসওএস আন্তর্জাতিক শিশুপল্লির প্রতিষ্ঠাতা, বিখ্যাত অস্ট্রীয় সমাজসেবক ড. হারম্যান মেইনার (১৯১৯-৮৬)। কৃষক পরিবারে জন্মেছিলেন হারম্যান। খুব ছোটবেলায় মাকে হারান। বড় বোনই তাঁকে মায়ের মতো বড় করেছেন। নিজের জীবন থেকে তিনি শিশু লালন–পালনে নারীর ভূমিকা অনুধাবন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের অনেক শিশু এতিম হয়ে পড়ে। এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন হারম্যান মেইনার। সেই ভাবনা থেকেই ১৯৪৯ সালে অস্ট্রিয়ায় প্রথম এসওএস শিশুপল্লি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এখন বিশ্বের ১৩৩টি দেশে এসওএস শিশুপল্লির কার্যক্রম চলমান আছে।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে আসেন হারম্যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে এসওএস শিশুপল্লি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। বঙ্গবন্ধুও তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেন। সেই বছরই বাংলাদেশে এসওএস (সোশ্যালি রেসপনসিবল সোসাইটি) শিশুপল্লির কার্যক্রম শুরু হয়। সেই অনুসারে ১৯৭২ সালে ঢাকার শ্যামলীতে দেশের প্রথম এসওএস শিশুপল্লি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ১৯৭৮ সালে রাজশাহীতে, ১৯৮২ সালে খুলনায়, ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামে, ১৯৯৪ সালে বগুড়ায় এবং সর্বশেষ ২০১১ সালে সিলেটে এসওএস শিশুপল্লি প্রতিষ্ঠিত হয়।