সুখী দাম্পত্য সম্পর্কে থেকেও কেন মানুষ প্রেমে পড়ে?

‘সময়ের সেরা জুটি’ আখ্যা পাওয়া দম্পতির একজন বা দুজনকেই দেখা যায় অন্য কারও প্রেমে পড়তে! অনেকের মতো আপনার মনেও প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘ওরা তো সুখেই ছিল, তবু কেন এমন হলো?’

সম্পর্কে তৃতীয় পক্ষের আগমনের অন্যতম প্রধান কারণ নতুনত্বের খোঁজ, ভিন্নতর আকর্ষণের অনুভূতি (প্রতীকী ছবি)
ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী শারমিন হক বলেন, ‘সম্পর্কের এমন রংবদলের নির্দিষ্ট কারণ সব সময় ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে মনের যে অংশটা অফুরান চাহিদা হাজির করে আমাদের সামনে, সেই অংশের কারসাজিতে এমনটা হতে পারে। সব আছে, তবু কিসের যেন অভাব—এমন একটা অনুভূতি থেকে কেউ নিজের সঙ্গী ছাড়া অন্য কারও প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়তে পারেন। কারও কারও ক্ষেত্রে অবশ্য পারিবারিক জীবনে কিছু বঞ্চনাও থাকতে পারে, যা হয়তো সামাজিক পরিসরে অন্যরা জানেন না।’

১. লাভ হরমোন

সম্পর্কে তৃতীয় পক্ষের আগমনের অন্যতম প্রধান কারণ নতুনত্বের খোঁজ, ভিন্নতর আকর্ষণের অনুভূতি। আবার অনেকেই নতুন প্রেমে পড়ার অভিজ্ঞতা, রোমাঞ্চের হাতছানি আগ্রাহ্য করতে পারেন না। বৈজ্ঞানিকভাবে, সম্পর্ক যখন পুরোনো হতে থাকে, তখন সেই সম্পর্ক শরীরের সুখানুভূতি বা হরমোনের নিঃসরণকে আগের মতো প্রভাবিত করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অক্সিটোসিনের অরেক নাম ‘লাভ হরমোন’। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে তৈরি হয়ে পিটুইটারি গ্রন্থির পেছনের অংশে জমা থাকে এবং প্রয়োজনের সময় সেখান থেকে নিঃসৃত হয়। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হলে মস্তিষ্কে ডোপামিন আর সেরোটোনিনের পাশাপাশি অক্সিটোসিনের নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে প্রেমানুভূতি তৈরি হয়।  

২. মনের মেঘের রংবদল

হরেক রঙের মেঘের মতো বিচিত্র সব ভাবনা খেলা করে মানুষের মনে। সবটাই যে আমরা সব সময় সচেতনভাবে ভাবতে পারি, এমন কিন্তু নয়। অবচেতন মনেরও হয় বহুমাত্রিক রূপবদল। তাই এমনটাও হতে পারে যে যিনি একটা ‘সুখী’ সম্পর্কে থাকা সত্ত্বেও অন্য কারও প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন, তিনি নিজেও বলতে পারছেন না, ঠিক কী কারণে, কীভাবে তৃতীয় কেউ তাঁর জীবনে চলে এল। স্রেফ একটা মানুষের প্রতি ‘ভালো লাগা’ থেকেই ‘প্রেম’ হয়ে যেতে পারে। বয়সের সঙ্গে প্রত্যেকের শরীরেই পরিবর্তন আসে। মনের চাহিদাও বদলে যায়।

অনেকে তো সরাসরি প্রাক্তনকে মন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ‘আনব্লক’ করে নতুন করে সম্পর্কটা চালু করেন (প্রতীকী ছবি)

৩. শরীরিক চাহিদার পার্থক্য

ম্যারিজ ডটকমে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, পুরুষদের অন্য নারীর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো—মাতৃত্ব, বয়সজনিত বা অন্য কোনো কারণে নারী সঙ্গীর শারীরিক পরিবর্তনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে না পারা। দুজনের শারীরিক চাহিদার পার্থক্যও অনেক সময় তৃতীয় পক্ষকে সম্পর্কে আমন্ত্রণ জানায়।

৪. অতীতের ছাপ

বিয়ের আগে গভীর প্রেমের সম্পর্কেও জড়ান কেউ কেউ। সব সম্পর্ক যে বিয়ের পরিণতিতে পৌঁছতে পারে, তেমনটা তো নয়। পরিণতি না পাওয়া সেই সম্পর্ক ‘ভুলে গিয়ে’ অন্য কাউকে বিয়ে করে সাময়িকভাবে সুখীও হন কেউ। তবে জীবনের কোনো এক মোড়ে দাঁড়িয়ে তিনি হয়তো পুরোনো সম্পর্কের নস্টালজিয়ায় ভুগতে পারেন। যদি তাঁর প্রাক্তনের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে—এমন কারও সঙ্গে পরিচয় হয়, তাহলেও কিন্তু তিনি নতুনভাবে এই মানুষটির প্রেমে পড়তে পারেন। আবার অনেকে তো সরাসরি প্রাক্তনকে মন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ‘আনব্লক’ করে নতুন করে সম্পর্কটা চালু করেন। অতীতের ছাপ এভাবেও পড়তে পারে বর্তমানে!

৫. দাম্পত্য সম্পর্ককে ‘ফর গ্রান্টেড’ হিসেবে নেওয়া

সময়ের সঙ্গে যেকোনো সম্পর্ক এগিয়ে চলে। সম্পর্কের গতিশীলতার সঙ্গে তাল মেলানোটা জরুরি। সময়ের সঙ্গে সংসার-সন্তানের দায়িত্ব বাড়লেও জুটি হিসেবে দম্পতির প্রাণবন্ত থাকাটা জরুরি। কর্মব্যস্ত দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে যদি একজন রোজই ঘুমিয়ে পড়েন চটজলদি, তাতে তো অপরজনের অভিমান হতেই পারে। দুটি কথা কিংবা একটু আলতো স্পর্শ থেকে যদি নিজেকে ‘বঞ্চিত’ অনুভব করেন কেউ, তাহলে জমতেই পারে অভিমানের মেঘ। যেকোনো একজন দাম্পত্য সম্পর্ককে ‘ফর গ্রান্টেড’ হিসেবে নিলে অপরজন তৃতীয় পক্ষের শরণাপণ্ন হতে পারেন। এমন অবস্থায় কেবল একটু কথা বলে মন ‘হালকা’ করার জন্যও যদি তিনি তৃতীয় কারো সঙ্গে মিশতে শুরু করেন, তাহলেও কিন্তু মনের অজান্তেই বোনা হয়ে যেতে পারে প্রেমের বীজ। এই মেলামেশা বা ‘নিছক বন্ধুত্ব’টি ভার্চ্যুয়াল জগতে হলেও কিন্তু গড়ে উঠতে পারে নতুন প্রেম।

শেষকথা

জীবনে চড়াই-উতরাই যতই আসুক, সম্পর্কে স্থিতিই প্রত্যাশিত। তাই সম্পর্কের প্রতি যত্নশীল হওয়াটা উভয় পক্ষেরই কর্তব্য। সম্পর্ক একটা গাছের মতো। নিয়মিত যত্ন নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তবেই সেখানে মৌসুমের সঙ্গে গজাবে নতুন নতুন কুড়ি, ফুল, ফল। যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে দুজন মানুষ একটি সামাজিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন, সেই প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়া অন্যায়। সঙ্গীর ছোট্ট ছোট্ট ভালো লাগার কাজ করতে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। আর মনে তৃতীয় কারও ভাবনা এলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখাটা জরুরি। তৃতীয় সম্পর্কটাকে মাত্রার ভেতরে রাখার নিয়ন্ত্রণ আপনার থাকতেই হবে। প্রয়োজনে মনের চিকিৎসাও করাতে পারেন।