বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী দুজনেই দুটি নতুন পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্কে যুক্ত হন। নতুন এই আত্মীয়তার শুরুতেই নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি হতে দেখা যায়। দীর্ঘদিন একটি পরিবারে একধরনের অভ্যাসের ভেতর দিয়ে বড় হয়ে নতুন জায়গায় এসে খাপ খাওয়াতে অসুবিধা হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমাদের সমাজব্যবস্থায় এ সমস্যায় বেশি পড়েন নারীরা।
শ্বশুরবাড়ির নতুন লোকজনের সঙ্গে মানিয়ে চলার বা সম্পর্ক গড়ে তোলার আলাদা কোনো বিদ্যালয় নেই। পরিবারই বিদ্যালয়। বড় পরিবারে থাকলে যেমন অনেক বিষয় সহজেই শেখা যায়, ছোট পরিবারে সেটা শেখার সুযোগ থাকে না। আসুন শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কীভাবে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলবেন, তার কিছু স্বর্ণসূত্র জেনে নিই।
১. বিয়ের পর নতুন পরিবারের মা–বাবার পাশাপাশি শিশুদের সঙ্গে প্রথমে সখ্য গড়ে তুলুন। শুরুতেই আপনার শ্বশুর বা শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একবার যদি তাঁদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে সহজে ও আনন্দের সঙ্গে তাঁরা আপনাকে গ্রহণ করবেন। দ্রুত তাঁদের কাছ থেকে যথাযথ সহযোগিতাও পাবেন। নতুন বাড়িতে পা রাখার পর থেকে এ সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করুন। পরিবারের অন্যদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ সহজ করে দিতে পারে এ সখ্য।
২. সংসার একটা দলীয় কার্যক্রম। তাই যার যার মা–বাবা সম্পর্কে দুজন দুজনকে সাহায্য করা জরুরি। স্বামী–স্ত্রী একজন অন্যজনের পরিবারকে জানতে ও চিনতে সহযোগিতা করুন। শ্বশুর বা শাশুড়ির কেউ স্পর্শকাতর হলে বা কথায় কথায় কারও দোষ ধরার অভ্যাস থাকলে সঙ্গীকে আগেই তার বিষয়ে অবহিত করুন, তাকে প্রস্তুত করুন। একেকজন মানুষকে একেকভাবে খুশি করা যায়। সেসব বিষয়ে আগে থেকে জানা থাকলে মিশতে সুবিধা হবে।
৩. দুই পরিবারের কাছের মানুষের একটা তালিকা তৈরি করুন আর তাদের ছোট–বড় গুণের কথাগুলো নিজেদের মধ্যে শেয়ার করুন। যাতে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় আপনি বলতে পারেন ‘আমি আপনার কথা অনেক শুনেছি।’ বিশেষ করে নিজের মা–বাবার চারিত্রিক ধরনগুলো সঙ্গীকে বুঝিয়ে বলুন। সঙ্গীর কাছ থেকে শোনা শ্বশুর-শাশুড়ির ভালো দিকগুলো প্রথম পরিচয়ে বলার চেষ্টা করুন, তবে খেয়াল রাখতে হবে কথাগুলো যেন কৃত্রিম বা আরোপিত মনে না হয়। কথা বলতে বলতেই যখন যেটা প্রাসঙ্গিক হবে বলে দিন। আপনি যখন বলবেন, ‘আমাকে আপনার এই গুণের কথা ও বলেছে, আমার খুব ভালো লেগেছে।’ এতে আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি খুশি হবেন। আপনাকে কাছে টেনে নেবেন। একইভাবে ছোট–বড় সবাইকে যথাসম্ভব প্রশংসা করুন। সব সম্পর্কেই যা খুব খুব কাজে দেবে। আপনার শ্বশুর–শাশুড়িকে পরিবারের অনেকেই হয়তো প্রভাবিত করেন, তাই সেই মানুষগুলোকেও গুরুত্বসহকারে নিন।
৪. আপনার কোনো কথা ধরে যেন পারিবারিক সংকট তৈরি না হয়, সেদিকে বিশেষ খেয়াল করুন। অনেক সময় কোনো কোনো বিষয়ে কিছু কথায় উত্তর দিতে খুব ইচ্ছা হবে, মনে হবে ভুল বলছেন তাঁরা। এমন পরিস্থিতিতেও চুপ থাকতে চেষ্টা করুন। হয়তো বিষয়টি পরে বুঝিয়ে বলতে পারবেন। ন্যায্য কথায় সম্পর্ক তিতা হয়। আর একটা তিতা কথার উত্তরে অনেক জটিল কথার সূচনা হয়। উত্তর দেওয়ার সুযোগ আপনি পরেও পাবেন। কিন্তু প্রথম দিন কাকে কী কী বলছেন, সেসব আচরণ নিয়ে আলোচনা করা অনেক পরিবারে সাধারণ বিষয়। তাই শুরুতেই বিতর্ক এড়িয়ে চলুন।
৫. প্রত্যেকের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। পরিবারের গুরুজনদের সঙ্গে হয়তো আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে আর আপনি মোবাইলে ব্যস্ত। বিষয়টি আপনার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করবে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতিতে সবাই ভাববে জামাই তো বিজি, আসলে আপনি হয়তো গেম খেলছেন বা চ্যাট করছেন। এটা বুঝলে তাঁরা অসম্মানিত বোধ করবেন, মন খারাপ করবেন। অনেক সময় কথা না বলে খাবার টেবিলে সেলফি আর খাবারের ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকেন বউ। এটা করা যাবে না। প্রথমবার রান্নার ছবি যদি তুলতেই ইচ্ছা করে, সেটা অন্য কেউ তুলুক, আপনি বাকিদের সঙ্গে আলোচনা করতে থাকুন। কারও কিছু লাগবে কি না নজর রাখুন। নতুন বউ, নতুন জামাই দুজনের জন্যই এ পরামর্শ।
৬. দাওয়াত খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা সম্পর্ক তৈরিতে ভালো ভূমিকা রাখে। দুই পরিবারের মা–বাবা দাওয়াতে একত্র হলে সেখানে সবাইকে সমান গুরুত্ব দিতে চেষ্টা করুন। নিজের মা–বাবাকে বেশি যত্ন নিলেন আর শ্বশুর-শাশুড়ির দিকে সেভাবে তাকালেন না, এটা ঠিক নয়। এতে শ্বশুর-শাশুড়ি যেমন কষ্ট পাবেন, আপনার সঙ্গীও বিরক্ত হবেন। ছেলেরা অনেক সময় এসব ক্ষেত্রে উদাসীন থাকেন, যা ভালো সম্পর্কের লক্ষণ নয়।
৭. শ্বশুর-শাশুড়িকে মাঝেমধ্যে ছোট ছোট উপহার দিতে পারেন। এতে তাঁরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। এক ধরনের ভালোবাসাও তৈরি হবে আপনার জন্য।
কথায় আছে, প্রথম পরিচয়ের অভিজ্ঞতাই শেষ পর্যন্ত মানুষ বয়ে বেড়ায়। দুই পরিবারের মানুষগুলোকে একবার আপন করে নিলে, দম্পতিদের নিজেদের মধ্যেও সম্পর্ক গাঢ় হবে। তাই নিজেদের স্বার্থেই নতুন মা–বাবাকে ভালোবাসতে হবে।
লেখক: বিয়ে বিষয়ক পরামর্শক