ইন্টারনেটের কারণে যোগাযোগে বিপ্লব ঘটে গেছে। ক্রমেই জনপ্রিয়তা বাড়ছে ডেটিং অ্যাপ আর ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটগুলোর। এমন সময়ে দাঁড়িয়ে এখনো যাঁরা ‘সিঙ্গেল’, তাঁদের নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটা ‘আহা উহু’ লক্ষ করা যায়। একা একা কাউকে রেস্তোরাঁয় খেতে দেখলে বা সমুদ্রসৈকতে একা ঘুরতে দেখলে আমরা অনেকেই আফসোস করে বলি, ‘আহা রে, লোকটার মনে কত কষ্ট’। যদিও গবেষণা সাধারণ মানুষের এই ধারণাকে অবান্তর বলে উড়িয়ে দিয়েছে অনেক আগেই। টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত, ২০০৮ সালে পরিচালিত একটা গবেষণা থেকে জানা যায়, সিঙ্গেল মানুষেরাও সম্পর্কে থাকা লোকজনের মতোই সমান সুখী, এমনকি কিছু কিছু কেস—এ বেশি সুখী!
একা থাকা তাঁদের সুখের ক্ষেত্রে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। সুখের ক্ষেত্রে সমানে সমান হলেও এমন কয়েকটি জায়গা আছে, যেখানে সিঙ্গেল লোকজন সম্পর্কে থাকা লোকজনের চেয়ে বেশি সুবিধা পায়। নিচের এই ৯টি কারণ জানার পর আফসোস নয়; বরং সিঙ্গেলদের নিয়ে আপনি ঈর্ষাও করতে পারেন।
মাথা ফ্রেশ থাকা
সম্পর্ক–বিশেষজ্ঞ সুসান উইন্টারের মতে, সম্পর্ক আপনার মানসিক অবস্থার জন্য বেশ ব্যয়বহুল একটা ব্যাপার। প্রতিদিন যে পরিমাণ সময় যুগলেরা অযথা কথা বলে বা ঝগড়া করে কাটায়, এই সময়ে আপনি নানা কিছু করতে পারেন। নতুন কিছু শিখতে পারেন। সৃজনশীল কাজে মনোনিবেশ করতে পারেন। নিদেনপক্ষে ঘুমাতে পারেন। অন্যদিকে মাথায় সম্পর্কে থাকা অনেকের মতো ‘সম্পর্কের চাপ’ থাকে না বলে সিঙ্গেল লোকজনের মাথায় নতুন নতুন চিন্তা আসার সুযোগ ও সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
একা মানুষ লক্ষ্যে অবিচল থাকতে পারে বেশি
ধরেন, আপনার সারা জীবন স্বপ্ন হলো সাগরে, জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবেন, পায়ে হেঁটে, জাহাজে কাটিয়ে দেবেন জীবন। কিন্তু ওদিকে আপনার প্রেমিকার কড়া হুঁশিয়ারি, বিসিএস ক্যাডার না হলে কিন্তু বাসায় মানবে না! ফলাফল? স্বপ্নের বিসর্জন! সিঙ্গেল থাকলে এই সমস্যা থাকে না; বরং আপনি কোনো পিছুটান ছাড়াই ছুটতে পারেন স্বপ্নের পেছনে।
নেই নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয়
সম্পর্কে জড়ানোর পর মানুষ সবচেয়ে বেশি যে অভিযোগটা করে, তা হলো অন্যকে মুগ্ধ করতে করতে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। মার্কিন মনোবিদ ড. ডেভিড ডারডাস্টির মতে, সম্পর্কে না জড়ালে একটা মানুষের জন্য নিজের প্যাশন ধরে রেখে সৃষ্টিশীল কাজ করাটা সহজ হয়ে পড়ে। এমন অনেক উদাহরণ আছে, সেখানে সম্পর্কে জড়িয়ে নিজের ‘সম্ভাব্য উজ্জ্বল ক্যারিয়ার’ শেষ হয়ে গেছে। কাজেই এখানেও এগিয়ে আছে সিঙ্গেলরাই।
জীবনে আপনি কী চান, এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সহজ হয়
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ডক্টর জেনি টাইপের মতে, এই আরাধ্য জীবনে আপনি আসলে কী করতে চান, সেটা খুঁজে বের করা উচিত সিঙ্গেল থাকা অবস্থাতেই। কারণ, তখন কেউ আপনার সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। ফলে আপনিই হয়ে ওঠেন আপনার একমাত্র শ্রোতা। তাই মনের কথা শোনা সহজ হয়ে উঠবে।
সিঙ্গেল থাকাই সেরা ‘অপশন’
সব সময়ই সম্পর্কে জড়ানো আপনার জন্য সেরা বিকল্প (অপশন) না-ও হতে পারে; বরং বিষাক্ত সম্পর্কে থেকে অসুখী হওয়ার চেয়ে একা একা সুখে থাকা অনেক ভালো। এমনকি এই সময় আপনি আপনার বন্ধুত্ব বা আত্মীয়তার সম্পর্কগুলোতে সময়, অনুভূতি দিয়ে জোরদার করতে পারেন। সিঙ্গেল না থাকলে যেটা অনেক সময় সম্ভব হতো না।
সিঙ্গেলরাই অর্থনৈতিকভাবে বেশি স্বাবলম্বী হয়
যদিও প্রচলিত মত হলো, সম্পর্কে জড়ালে মানুষ দায়িত্বশীল বেশি হয়। কিন্তু গবেষণা বলে, সিঙ্গেল অবস্থাতেই মানুষ নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে বেশি সচেতন হয়। মিতব্যয়িতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের অবস্থার উন্নতি করতে থাকে।
অগ্রাধিকার তালিকায় নিজেকে সবার ওপরে রাখা
‘তোমার জন্য সকাল দুপুর, তোমার জন্য সন্ধ্যা। তোমার জন্য সকল গোলাপ এবং রজনীগন্ধা।’
হেলাল হাফিজের কবিতাটা পড়তে বেশ ভালোই লাগে। তবে সব সময়ই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় অন্য একটা মানুষকে ‘অগ্রাধিকার’ দেওয়া খুব কঠিন! সিঙ্গেল বা একাকিত্ব এই চাপ ও ক্লান্তি থেকে মুক্তি দেয়। সিঙ্গেল অবস্থায় আপনার ‘প্রায়োরিটি’ লিস্টে শুধু আপনিই থাকবেন, আর কেউ নন।
নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ট হওয়া
ড. উইন্টারের মতে, সিঙ্গেল হওয়া মানেই একা হয়ে যাওয়া নয়; বরং এই সিঙ্গেল অবস্থাতেও আপনি নিজেই হয়ে উঠতে পারেন নিজের সবচেয়ে ভালো সঙ্গী। এতে যেমন অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে, তেমনি নিজেকে আরও ভালো করে চেনা হয়ে যাবে অনেকখানি।
আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ
মানসিক স্বস্তি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা, একা একাই চলতে পারা—সবকিছু মিলিয়ে এই সিঙ্গেল জীবন আপনাকে এত বেশি আত্মবিশ্বাস এনে দিতে পারে, যা কোনো মানুষ কখনোই আপনাকে দিতে পারত না। আপনার পথ চলতে আপনি নিজেই যথেষ্ট, এর চেয়ে সুন্দর কিছু এই পৃথিবীতে আর আছে? যে নিজেই নিজেকে কফি বা নতুন কোনো খাবার ট্রিট দিতে জানে, রেস্তোরাঁ থেকে বাইরে তাকিয়ে একা একা ঝুপ করে সন্ধ্যা নামার সৌন্দর্য উপভোগ করে—তার কাছে সম্পর্কে থাকাটাই বরং কঠিন।
সম্পর্কে জড়ানোও খারাপ নয়, আবার সিঙ্গেল থাকাও মন্দ নয়। যে যেভাবে আছে, সেখানেই নিজের স্বস্তি আর স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। যৌথ জীবনে তো বটেই, আবার সিঙ্গেল থাকলেও আমার আপনার পক্ষে চমৎকারভাবে জীবনকে গুছিয়ে নেওয়া সম্ভব। ‘ঠিকঠাক’ একজন জীবনসঙ্গী আমাদের সবার কাম্য। তবে যদি না-ই পাওয়া যায়, তখন ঘাবড়ে যাওয়া যাবে না বা হীনম্মন্যতায় ভোগারও কিছু নেই; বরং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বলতে পারতে হবে, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’!
সূত্র: টাইম ম্যাগাজিন