অন্যকে নিয়ন্ত্রণকারী স্বভাবের পুরুষ (এমনকি নারীরাও) সঙ্গীকে তার পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করে
অন্যকে নিয়ন্ত্রণকারী স্বভাবের পুরুষ (এমনকি নারীরাও) সঙ্গীকে তার পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করে

আমার প্রেমিক আমাকে বন্ধুদের সঙ্গেও মিশতে দেয় না, কী করব?

যুক্তরাজ্যের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার লাইফস্টাইল বিভাগে নিচের প্রশ্নটি পাঠিয়েছিলেন এক নারী পাঠক। প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছিলেন সাংবাদিক এবং কলামিস্ট অ্যানালিসা বারবেইরি

আমার প্রেমিকের সঙ্গে পরিচয় এক বছর আগে। আমি তখন চাকরি নিয়ে তার দেশে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমি পাগল হয়ে যাব। জানি না, আমি কী করব!

দেখা হওয়ার এক মাস পরই সে আমাকে ভালোবাসার কথা জানায়। সম্পর্ক হওয়ার পর একবার বলেছিলাম, আমি আমার এক পুরোনো বন্ধুর (পুরুষ) সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। ও আমাকে জানিয়ে দিল, যদি আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই, তাহলে আমাদের সম্পর্ক আর থাকবে না। ও কয়েকবার আমার ফোন হাতিয়েছে। বলেছে, আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গেও আমাকে দেখা করতে দেবে না। কারণ, তার মতে, আমার বান্ধবী নাকি অভদ্র। ও নিয়ম জারি করেছিল, বিকেলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর আমি যেন বাইরে না যাই (আমি এমনিতেও বাইরে খুব একটা যাই না)।

ও এমনকি আমার কুকুরটাকেও ঘৃণা করে। হুমকি দেয়, হয় আমার কুকুর থাকবে, নয়তো সে। একবার কথা দিয়েছিল, আমার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আর যায়নি।

এ ছাড়া সম্পর্কের খুব অল্প দিনের মধ্যেই ও আমাকে বহুবার ছেড়ে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছে। ও বলে, আমি নাকি ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আমার যত পরিচিত পুরুষ আছে, সবাইকে ও ব্লক করে দিতে বলেছে। আমাকে একবার বলেছিল, আমার জন্য ও নাকি একটা আংটি কিনেছিল। কিন্তু আমি ওকে মিথ্যা বলায় আংটিটা দেয়নি। কাজের জন্য ও কয়েক সপ্তাহ বাইরে ছিল। তখন ঠিক করেছিলাম, এক বন্ধুর সঙ্গে কয়েক দিন একটু বেড়িয়ে আসব। এ কথা শুনেই ও রেগে গিয়েছিল। মাঝেমধ্যে ওকে খুবই কমনীয় মনে হয়। কিন্তু মনে হয় না ওর আচরণ স্বাভাবিক। আমাকে কি সাহায্য করতে পারেন?

উত্তর: আপনি ঠিকই বলেছেন। তাঁর আচরণ স্বাভাবিক নয়। এতে আপনিও ভালো নেই। তাঁর আচরণ সহিংস এবং তিনি আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন...এ ধরনের আচরণ, জোরজবরদস্তি করে কাউকে নিয়ন্ত্রণ করা দণ্ডনীয় অপরাধ।

অন্যকে নিয়ন্ত্রণকারী স্বভাবের পুরুষ (এমনকি নারীরাও) সঙ্গীকে তার পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা প্রায়ই সঙ্গীর পরিবার-পরিজন এবং বন্ধুদের এমন একটা ‘দোষ’ খুঁজে বের করে, যেটা আপনি জানতেনই না। তারা হয়তো বলবে, ‘আমাকে যদি ভালোবাসো, তাহলে তোমাকে এটা করতে হবে কিংবা তুমি ওটা করতে পারবে না।’ তবে মনে রাখবেন, এটা শুধুই আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা কৌশল। এর সঙ্গে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই।

আপনার চিঠিটা নিয়ে সাহায্যের জন্য আমি ‘রিফিউজ’-এ গিয়েছিলাম। এটি যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় পারিবারিক নির্যাতনবিরোধী সংস্থা। যদিও জানি, আপনি যুক্তরাজ্যে থাকেন না, তারপরও বলি, সঙ্গীকে সব সময় নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া ব্যক্তিদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পরামর্শ সবখানেই এক। আমরা অনুরোধ করব আপনার কাছের কোনো পারিবারিক নির্যাতনবিরোধী সংস্থায় যোগাযোগ করতে।

আপনাকে ভয় দেখাতে চাই না। কিন্তু আমি চাই, আপনি নিরাপদে থাকুন। একজন নিপীড়ক পুরুষের আচরণ আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, যখন একজন নারী তার কাছ থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে।

পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে এবার কিছু বলি। অনেকেই নির্যাতনের কথা শুনলে মাথা নেড়ে অস্বীকার করে। বলে, ‘ও তো আমাকে আঘাত করেনি। এটা কোনো নির্যাতন নয়।’ তবে নির্যাতন যে শুধু শারীরিকই হতে হবে, তা নয়। আগ্রাসী আচরণ, মানসিক নির্যাতন, অর্থনৈতিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন—সবই নির্যাতন। এসব ক্ষেত্রে নিপীড়ক ব্যক্তিটি ভিকটিমকে বিশ্বাস করাতে থাকে যে সব দোষ তার, অর্থাৎ ভুক্তভোগীর। নিজের মানসিক সুস্থতা নিয়েও তার সন্দেহ হতে থাকে। যদি আপনার মনে হয় যে শুধু আপনার সঙ্গীকে শান্ত করতেই আপনি নিজের জীবনযাপন বা আচরণে পরিবর্তন করে ফেলছেন কিংবা সারাক্ষণ আপনাকে ভয়ে ভয়ে থাকতে হচ্ছে যে না জানি কখন কী কারণে সে রেগে যায়, এর মানে হলো আপনি নির্যাতনের শিকার। ‘রিফিউজ’–এর ভাষ্যে, কোনো নারী যদি মনে করেন যে কিছু একটা ঠিক নেই, তাহলে সাধারণত এর মানে হলো, কিছু একটা আসলেই ঠিক নেই।

এটা উপলব্ধি করা জরুরি যে আপনি যা-ই করুন না কেন, নিজেকে যতই ছোট করুন না কেন, আপনার সঙ্গী কখনোই খুশি হবে না, কখনোই বদলাবে না। সে সব সময়ই চেষ্টা করবে আপনাকে দোষারোপ করতে।

এ ক্ষেত্রে ‘রিফিউজ’-এর পরামর্শ হলো, ‘আপনি সাহায্য চাওয়ার জন্য কাউকে খুঁজে বের করুন। এমন কেউ, যার ওপর আপনি আস্থা রাখতে পারেন এবং যে আপনাকে সমর্থন দেবে। এমন কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করুন, যারা আপনার দেশে পারিবারিক নির্যাতন রোধে কাজ করে।’

আপনি এমন কিছু মানুষের সান্নিধ্যে থাকার চেষ্টা করুন, যারা আপনার সমস্যা সম্পর্কে জানে। কিন্তু কোনো বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এই কথা বারবার বলছি; কারণ, এতে আপনি কীভাবে আপনার প্রেমিককে ছেড়ে যাবেন, সে ব্যাপারে একটি নিরাপদ পরিকল্পনা করতে পারবেন। দয়া করে আপনার প্রেমিককে আপনার পরিকল্পনার কথা জানতে দেবেন না। কারণ, একজন নারীর জন্য একটি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আপনাকে ভয় দেখাতে চাই না। কিন্তু আমি চাই, আপনি নিরাপদে থাকুন। একজন নিপীড়ক পুরুষের আচরণ আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, যখন একজন নারী তার কাছ থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে।

অনুবাদ: আলিয়া রিফাত