প্রেমে ছ্যাঁকা খেলে কী করবেন

দীর্ঘদিন একসঙ্গে চলার পরও অনেক সম্পর্ক পরিণতি পায় না। মডেল: আহসান ও উর্বি
ছবি: অধুনা

প্রেমের বাতাস গায়ে লাগলে অনেকেই বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেন। নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত অন্যের হাতে সমর্পণ করে দেন। বিশেষ করে কম বয়সের প্রেমে এটা বেশি হয়। তবে জীবনের একটি পর্যায়ে এসে সবাই এমন একজন সহযোগী চান, যার বন্ধুতা, ভালোবাসা এবং যত্নে বাকি জীবন সহজে পার করা যায়। ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা, দীর্ঘদিন একসঙ্গে চলার পরও অনেক সম্পর্ক পরিণতি পায় না। ইতি টানতে হয় মাঝপথে। নানা কারণে একজন আরেকজনকে ছেড়ে চলে যান, প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটে। একপক্ষ তখন নিজেকে প্রতারিত মনে করেন। তবে প্রতারণার শিকার হওয়া মানেই যে জীবন থেমে যাবে তা কিন্তু নয়। নতুন পথচলায় এবার হয়তো যাকে সঙ্গে পাবেন, তিনি আপনার জীবন রঙিন করে তুলবেন। জেনে রাখুন, প্রেমে প্রতারিত হলে কী করবেন—

১. বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে ব্যক্তি প্রতারিত হন, সম্পর্কে যুক্ত থাকার সময়েও সে–ই বেশি ভুক্তভোগী ছিলেন। হয়তো তার পছন্দকে দমিয়ে নিজের পছন্দকে বেশি গুরুত্ব দিতেন পার্টনার। এমন কর্তৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেয়ে বরং নিজেকে আরও ভালোবাসুন। আপনি এখন নিজের পছন্দের খাবার খেতে, পোশাক পরতে বা কাজ করতে পারবেন। এতে বরং আপনার নিজের আরও খুশি হওয়া জরুরি। এই সময়ে নিজেকে বেশি করে ভালোবাসুন।

প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে গেলে নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করুন। প্রতীকী এই ছবিতে মডেল হয়েছেন আরজু আফরিন

২. মনোবিদেরা বলেন, প্রেম ভেঙে যাওয়ার পরের তিন মাস একজন মানুষের মানসিক অবস্থা সবচেয়ে খারাপ থাকে। যার সঙ্গে আলাপে–আড্ডায় দিন–রাতের প্রায় বেশির ভাগ সময় কাটত, যাকে ঘিরে ভবিষ্যতের স্বপ্ন সাজাতেন, অনেকে সেই মানুষটির অনুপস্থিতি হুট করে মেনে নিতে পারেন না। কিন্তু নিজের জন্য এবং পরিবারের বাকি সদস্যদের (যারা আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন) জন্য হলেও নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জোবায়ের মিয়া বলেন, ‘ভুক্তভোগীর মানসিক এই বিপর্যয়ের মধ্যেও প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যেতে হবে। যেমন নিজে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকা, প্রতি বেলায় ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, নিজের কষ্টের কথা খোলামেলা আলোচনা করা, ভালো বন্ধুদের সঙ্গে নিজের মনের কথা বলার মতো কাজগুলো চালিয়ে যেতে হবে। এই সময়ে পরিবারের সদস্যদেরও উচিত তাকে মানসিকভাবে সাহায্য করা, চোখে চোখে রাখা; যাতে সে ভুল কোনো চিন্তা মাথায় না আনে।’

৩. প্রাক্তনের কোনো স্মৃতি চোখের সামনে রাখবেন না। প্রেমের সময় প্রাক্তনের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন উপহার যা দেখে আপনি কষ্ট পেতে পারেন, সেসব অন্য কাউকে দিয়ে দিতে পারেন। সাবেকের পছন্দের জিনিস, জায়গা, খাবার, সুগন্ধী—এসবের মধ্যে নিজেকে আটকে না রেখে স্বাভাবিক হতে হবে। পরিস্থিতির জন্য নিজেকে দোষারোপ না করে নিজেকেই সাহস দিন, নিজে পথচলার নতুন অধ্যায় শুরু করুন।

বিচ্ছেদ মানেই সব শেষ না। মডেল: কোকো ও বৃষ্টি

৪. অনেক সময় অনলাইন দুনিয়ার নিয়মিত ফলোআপ স্বাভাবিক হওয়ার পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে মনের ক্ষত সারানোর জন্য প্রাক্তনের ফোন নম্বর, ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম আইডি কিছুদিনের জন্য ব্লক বা স্নুজ করে দেওয়াই ভালো। সাবেকের প্রোফাইল স্টক করলে আপনি কখনোই দুর্বিষহ অতীত থেকে বেরোতে পারবেন না। তাই বিচ্ছেদ হলে এসব ছেড়ে পুরোপুরি নতুনভাবে বাঁচতে চেষ্টা করুন।

৫. ব্রেকআপের পর আপনার আবেগের সঙ্গে আপনাকেই লড়াই করতে হবে। এই সময়ে মন খারাপ হওয়া, কান্না আসা, পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছা না করার মতো বিষয়গুলো স্বাভাবিক। এগুলোকে দমিয়ে না রেখে ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এখন ঝাড়া হাত–পা নিয়ে আপনি বরং আরও দ্বিগুণ গতিতে ছুটতে থাকুন।

বিচ্ছেদ মানেই জীবন শেষ না

৬. মনমরা অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে হবে। শখের বাগান করা বা রুম গোছানো, বই পড়া, প্রিয় পশুপাখির যত্ন নেওয়া, আর্টক্রাফট, কলেজ বা ভার্সিটির বিভিন্ন ক্লাব বা সংগঠনে যুক্ত হওয়া, নতুন ভাষা শেখা, রান্না, সাঁতার বা পছন্দের কোনো কোর্সে ভর্তি হওয়া ভালো। এগুলো আপনাকে ব্যস্ত রাখতে সাহায্য করবে। প্রাক্তনের সঙ্গে থাকা ছবি, রোমান্টিক গান বা সিনেমা যা আপনাকে কষ্ট দেয়, তা আপাতত না দেখে কমেডি, রহস্য বা অ্যাডভেঞ্চার টাইপ সিরিজ, সিনেমা দেখার মাধ্যমে নিজেকে প্রফুল্ল রাখতে পারেন।

৭. নিজের যত্ন নিন। ত্বকের যত্ন, চুলের যত্ন, রিলাক্সিং ম্যাসাজ, স্পা করালে ভালো লাগবে। নিজের বাথরুমে মোম জ্বালিয়ে লম্বা সময় ধরে একটা লাক্সারি শাওয়ার নিতে পারেন। নিজের জন্য ছোট ছোট নোট লেখা, এমনকি জানালা খুলে গায়ে সকালের রোদ মাখা, বৃষ্টিতে ভেজা, আগের প্লে লিস্ট পরিবর্তন করে নতুন প্লে লিস্ট তৈরি করতে পারেন। আপনার নতুন পথচলায় সাহায্য করতে পারে এসব জিনিস।

চুল কেটে নিজের ক্ষতি করার কোনো দরকার নেই

৮. প্রেমে প্রতারিত হয়ে অনেকেই মনঃকষ্টে হুট করে নিজের চুল কেটে ফেলেন, গায়ে ট্যাটু করান বা প্রাক্তনের ক্ষতির চেষ্টা করেন। দেখুন, আবেগতাড়িত হয়ে হুট করে কোনো কাজ করা ঠিক না। এগিয়ে যাওয়ার জন্য সময় নিন। ছোট ছোট সংকল্প করুন। মানসিক অশান্তি, ক্রোধ, বিষাদ থেকে মুক্তির জন্য ধ্যান করতে পারেন। মানসিক বিধ্বস্ততা অনেকেই সামলাতে না পেরে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে চলে যান। এই অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য না। তবে এমন পরিস্থিতি যদি তৈরি হয়ে যায়, তাহলে বিভিন্ন থেরাপি বা কাউন্সেলিং সেশনের সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দেন ডা. মো. জোবায়ের মিয়া।

একটা খারাপ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য হুট করে আরেকটা সম্পর্কে যুক্ত হয়ে যাবেন না। আগে নিজেকে জানুন। নিজের একান্ত লক্ষ্যগুলো পূরণে কাজ করুন। নতুন সম্পর্কে জড়ানোর আগে বুঝে নেওয়ার দরকার আছে। ‘জীবন একটি চকলেটের বাক্সের মতো, আপনি কখনই জানেন না আপনি কী পেতে যাচ্ছেন’—ফরেস্ট গাম্পের সেই বিখ্যাত উক্তিটি হয়তোবা জীবনের এমন বিশেষ মোড়ের জন্যই যথার্থ। অপেক্ষা করুন, আপনার যোগ্যতার প্রতিদান সময় আপনাকে দেবেই।