শিশুর খেলায়, শিশুতোষ ‘আড্ডা’য় খানিকটা খুনসুটি তো থাকতেই পারে। কিন্তু তা যদি অন্যকে মানসিক বা শারীরিক আঘাত করার মতো মারাত্মক পর্যায়ে চলে যায়, তখন সেটা আর অবহেলার বিষয় থাকে না। অন্য শিশুর কাছ থেকে শারীরিক বা মানসিক আঘাত পেয়ে আসা শিশুটির প্রতি আমরা যেমন সহানুভূতিশীল হই, ঠিক তেমনই যে শিশুটি অন্যকে আঘাত করছে, তার প্রতি আমাদের অধিকাংশের মনোভাবই হয় ভীষণ বিরূপ। আমরা অনেকেই ভুলে যাই, ‘অন্যায়’ করলেও কিন্তু সে একটি শিশু। মারধর, বকাবকি না করে বরং সে কেন এই ‘অন্যায়’ করেছে, তা খুঁজে বের করা জরুরি। তার মধ্যকার ‘ভালো’টাকে প্রস্ফুটিত করার কাজটা একটু কঠিন মনে হলেও অসম্ভব নয়।
সন্তানের ‘অন্যায়’-এর ফিরিস্তি শুনে আপনার রাগ হতেই পারে, কিন্তু সেই মুহূর্তে নিজেকে শান্ত রাখা খুবই জরুরি। এ ধরনের বিষয় নিয়ে সন্তানের সঙ্গে এমন একটা সময় কথা বলতে হবে, যখন আপনি ও আপনার সন্তান দুজনেই শান্ত অবস্থায় থাকবেন। তাকে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করে শাসনের ভঙ্গিতে কথা বলা যাবে না। তাতে তার মনে ক্ষোভ জন্মাবে। বরং তার কথা আন্তরিকভাবে শুনতে হবে, তার আবেগ-অনুভূতির দিকটাও বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য তাকে ইতিবাচক কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন। এমনটাই বলছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিশু–কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. টুম্পা ইন্দ্রানী ঘোষ।
নির্দিষ্ট কোনো ‘অন্যায়’ প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইলে ঠান্ডা মাথায় শিশুর কাছে জানতে চান, ওই সময় ঠিক কী হয়েছিল। এমনও হতে পারে, কেউ আপনার শিশুকে আঘাত করে কিছু বলার কারণে সে রেগে গিয়ে ‘বড়’ কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। আর সেটাই সবার কাছে ‘ফোকাস’ হয়েছে। আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, ‘সামান্য’ আঘাতের ‘প্রতিশোধ’ নিতে গিয়ে সে কেন ‘বড়’ কিছু করে ফেলছে? আবার এমনও হতে পারে, প্রায় বিনা কারণেই শিশু অন্যকে আঘাত করছে। এ ক্ষেত্রেও আপনি ভাবতে পারেন, কেন এমন হচ্ছে? সে কি কোনো কিছু নিয়ে খুব চাপ অনুভব করছে? এ ধরনের সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে জেনে রাখুন, পারিবারিক পরিসরের নেতিবাচকতা শিশুর ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। দাম্পত্য কলহ কিংবা পারিবারিক ‘ঝগড়া’র সাক্ষী হয়ে বেড়ে ওঠা শিশুরা অন্যের প্রতি বিরূপ আচরণ দেখাতে পারে। অতিরিক্ত শাসন কিংবা শিশুর মতামতকে অবহেলা করলে সেই শিশু অন্যের প্রতি অমানবিক আচরণ করতে পারে। আবার নৃশংসতা বা হিংস্রতার প্রকাশ হয়, এমন ভিডিও দেখলে বা গেম খেললে বাস্তব জীবনে সেটির প্রকাশও ঘটাতে পারে শিশু।
কারণ খুঁজে পেলে সেই সমস্যার সমাধান করুন। পরিবারের সবাইকেই সংযত আচরণের চর্চা করতে হবে। শিশুর প্রতি যত্নশীল হোন। স্বাস্থ্যকর খাবারদাবারের প্রতি উৎসাহী করে তুলুন। শারীরিক শ্রম হয়, বিশেষ করে লাফঝাঁপ করতে হয়, এমন খেলাধুলার সুযোগ দিন। সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা বা কারাতে শেখাতে পারেন। এভাবে শিশুর নেতিবাচক শক্তিটুকু ইতিবাচক কাজে ব্যয় করতে সাহায্য করুন। ছবি আঁকা বা অন্যান্য সৃজনশীল কাজেও উৎসাহ দিন। শিশুর ‘ভালো’ কাজের প্রশংসা করুন। মাঝেমধ্যে পুরস্কারও দিতে পারেন। তার আবেগকে গুরুত্ব দিন। ভালোমন্দের পার্থক্য বুঝিয়ে বলুন। কাউকে কষ্ট দিতে নেই, এমনকি একটি পিঁপড়া বা একটি গাছকেও নয়, তার মধ্যে এই বোধটুকু তৈরি করুন। অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীলতা প্রকাশ পায়, এমন কাজে শিশুকে যুক্ত করুন। অন্য কারও উপস্থিতিতে শিশুর সম্পর্কে এমন কিছু বলবেন না, যা শিশুর আত্মমর্যাদায় আঘাত হানতে পারে।
স্কুলে এমন সমস্যা হলে শিক্ষকের সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক তাকে ক্লাসে প্রথম সারিতে বসাতে পারেন। পড়ানোর সময় একাধিকবার তার নাম ধরে কথা বলতে পারেন, আবৃত্তি করতে সামনে ডাকতে পারেন। তার ‘ভালো’ কাজের প্রশংসা করতে পারেন। ক্লাসে কিছু বিতরণ করতে হলে তাকে সাহায্য করতে বলতে পারেন, এমনকি তাকে ক্লাস ‘ক্যাপ্টেন’-এর দায়িত্বও দিতে পারেন।