১৭ জুলাই। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের আলোচিত সংবাদ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সারলেট আর বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুরের সোহেল হোসাইনের বিয়ের খবর। তবে এই দম্পতিই শুধু আলোচিত সংবাদে পরিণত হয়েছেন তা নয়, এর আগেও একাধিক দম্পতি আলোচনায় এসেছেন।
বিভিন্ন দেশ থেকে প্রেমের টানে বাংলাদেশে এসে বিয়ে করার পর এ বিয়ে কত দিন টিকবে, মেয়ে কত দিন পর দেশে ফিরে যাবেন, এ ধরনের আলোচনার শেষ নেই। প্রথম আলোয় প্রকাশিত এ ধরনের বিয়ের খবরের বর ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়। বউ হয়ে আসা সব নারী ভালো আছেন, তা বলার উপায় নেই। কেউ কেউ চরম প্রতারণার শিকারও হয়েছেন, তা থানা পর্যন্ত গড়িয়েছে।
লক্ষ্মীপুরের সোহেল জানিয়েছেন, ২০১৩ সালে ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগের পর ২০১৬ সালের জুন মাসে সারলেট বাংলাদেশে এলে তাঁরা বিয়ে করেন। কিন্তু তাঁর পরিবার তখন ওই বিয়ে মেনে নেয়নি। সারলেট তখন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। এবার সবাইকে মানিয়ে তাঁর পরিবারের কাছে এসেছেন সারলেট। মার্কিন নববধূকে দেখতে এলাকার হাজার হাজার মানুষ ভিড় করায় নিরাপত্তার কারণে সোহেল স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় একটি হোটেলে উঠতে বাধ্য হন।
শুধু এ দম্পতি নন, এ ধরনের বিয়ে করা প্রায় প্রত্যেক দম্পতিকেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। পরিবারকে রাজি করাতেই লেগে যায় কয়েক বছর।
চলতি বছরের জুন মাসে নেত্রকোনার কলমাকান্দার গুতুরা বাজারের জসিম উদ্দিন আর চীনা নাগরিক ইবনাত মরিয়ম ফাইজার বিবাহোত্তর বউভাতের আয়োজন করা হয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম আজাদের বাড়িতে। তাঁদের বিয়ে হয় দুবাইয়ে। চাকরিসূত্রে ফাইজা ও জসিমের পরিচয় দুবাইয়ের একটি শপিং মলে। এই দম্পতি বর্তমানে চীনে আছেন, সেখানে চীনের রীতি অনুযায়ী বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হবে বলে জানালেন জসিম উদ্দিনের ভাই ওয়াসিম আকরাম। জানালেন, এই বিয়েতে মা–বাবাসহ পরিবারের অন্যদের রাজি করাতে তাঁর ভাই তিন থেকে চার বছর ধরে চেষ্টা করছিলেন। ইবনাত মরিয়ম ফাইজা নিজের ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম হন। এই দম্পতি এখন ভালো আছেন, সুখে আছেন বলে জানালেন ওয়াসিম। নতুন বউ কাজ চালানোর মতো বাংলা বলতে পারেন।
২০১৭ সালের মে মাস। নাটোরের আদালতে বিয়ে করে দম্পতি হলেন থাইল্যান্ডের সুপুত্তো ওরফে ওম ওরফে সুফিয়া খাতুন এবং বাংলাদেশের অনিক খান। কনের বয়স বেশি। এই কনে ছেলের পরিবারের বিয়ের সমর্থন আদায়ে অনশন করেন। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার এক দিন আগে অবশেষে বিয়ে হয়। অনিক খানের পড়াশোনা তেমন নেই।
প্রেমের টানের বড় মাধ্যম ফেসবুক
চলতি বছরের জুন মাসে প্রেমের টানে জার্মান নাগরিক অ্যাসটিট ক্রিস্টিয়াল কাসুমি সিউর স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করে খুলনা নগরের খানজাহান আলী এলাকার যুবক আসাদ মোড়লের প্রেমে মুগ্ধ হয়ে এ দেশে চলে আসেন।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, আসাদ মোড়ল তেমন পড়াশোনা করেননি। মাঝেমধ্যে তিনি শ্রমিকের কাজ করেন। ফেসবুকে তাঁর সঙ্গে জার্মান নারীর পরিচয়। প্রায় দুই বছর ধরে কথা বলতে বলতে প্রেম। ক্রিস্টিয়াল প্রেমের সম্পর্ককে বাস্তবে রূপ দিতে জার্মানি থেকে প্রথমে ঢাকায় আসেন। পরের দিন তিনি ঢাকা থেকে আসাদের খোঁজে খুলনায় আসেন এবং একটি হোটেলে ওঠেন। ওই হোটেলেই দুজনের প্রথমবারের মতো দেখা হয়। ১২ জুন ক্রিস্টিয়াল খুলনা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ১৩ জুন তাঁদের বিয়ে হয়।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরের ঘটনা। ফেসবুক সূত্রে প্রেমের পর ইন্দোনেশিয়া থেকে বাংলাদেশের পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় হাজির হন নিকি উল ফিয়া (২০) নামের এক তরুণী। নিকি পেশায় শিক্ষক আর ইমরান তখনো শিক্ষার্থী।
২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে ঝিনাইদহের মিঠুন বিশ্বাস আর মার্কিন তরুণী এলিজাবেথের বিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনায় আসে। ফেসবুকের সূত্রে তাঁদেরও পরিচয় ছিল। আড়াই বছরের সম্পর্কের পর তাঁরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন।
২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে ব্রাজিল থেকে বাংলাদেশে ছুটে আসেন জেইসা ওলিভেরিয়া সিলভা। ফেসবুকে প্রেম হয় রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের বাজার এলাকার সঞ্জয় ঘোষের সঙ্গে। সঞ্জয় পরিবহনশ্রমিক। জেইসা ছিলেন চাকরিজীবী। প্রেমের টানে শুধু দেশ নয়, পেশা, বয়স বা আর্থিক অবস্থান কোনো কিছুই বাধা হতে পারেনি।
২০১৮ সালের এপ্রিল মাস। যুক্তরাষ্ট্রের শ্যারুন খান আসেন ফরিদপুরের ছেলে আশরাফ উদ্দিনের কাছে। পিএইচডি করা শ্যারন নিউইয়র্কের একটি ব্যাংকে কাজ করছেন। এ ক্ষেত্রেও প্রেমের মাধ্যম ছিল ফেসবুক। সাত মাস ফেসবুকে চলে যোগাযোগ। গত বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে আশরাফ উদ্দিন জানালেন, তিনি বর্তমানে ঢাকায় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। চলতি মাসেই বিদেশি স্ত্রীর দেশে আসার কথা আছে। স্ত্রী আসার পর বিয়ের প্রথম বার্ষিকীর আনুষ্ঠানিকতা পালন করবেন।
প্রতারণাসহ বিভিন্ন কারণে ফিরে যাওয়া
প্রেমের টানে টাঙ্গাইলের সখীপুরে আসা মালয়েশীয় তরুণী জুলিজা বিনতে কামিস ১৭ দিন পর নিজ দেশে ফিরে যান ২০১৭ সালে। কলেজছাত্র মনিরুলের সঙ্গে পরিচয় ফেসবুকে। বিয়ের আয়োজন চলছে, এই সময় আজগর আলী নামের আরেক জন জুলিজার স্বামী পরিচয় দিয়ে ফোন দিলে বিয়ে বাতিল হয়।
প্রথম আলোর খবর বলছে, ২০০০ সালের দিকে আজগর আলীর সঙ্গে মালয়েশিয়ায় জুলিজার প্রেম, ২০০৮ সালে বাংলাদেশে এসে বিয়ে হয়। বিয়ের পর মালয়েশিয়ায় ফিরে যান তাঁরা। চার সন্তানের জন্ম হয়। হুট করেই গণমাধ্যমে মনিরুলের সঙ্গে বিয়ের খবর দেখে আজগর আলী ফোন দেন।
২০১১ সালের মে মাসের ঘটনা। প্রেমিকের দেশ বাংলাদেশ, আর প্রেমিকার দেশ ভারত। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ছেলে, আর প্রেমিকা ছিলেন ছেলের মামাতো বোন। প্রেমের মাধ্যম মুঠোফোন। প্রেমে বড় বাধা ছিল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। দুই বাহিনী পতাকা বৈঠক করতে বাধ্য হয়। মেয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে চলে এলে তাঁর পরিবার ছেলের নামে অপহরণের অভিযোগ তোলে। বিজিবির সদস্যরা মেয়েটিকে উদ্ধার করে বিএসএফের কাছে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেয়। এর আগেই ছেলের পরিবার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলে গ্রামবাসী ও বিজিবির সদস্যদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, তা গড়ায় থানা-পুলিশ পর্যন্ত। তবে শেষ পর্যন্ত মেয়েকে নিজ দেশে ফিরে যেতে হয়।
বিয়ের দুই বছর পর শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসেন ফিলিপাইন তরুণী এইমি গ্রাসি মার্ভালিয়াস। বাংলাদেশি তরুণ সালমানুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হয়েছিল সিঙ্গাপুরে ২০১৪ সালে। এক বছর পর বিয়ে করেন। তবে বাংলাদেশে এসে এ তরুণী জানতে পারেন, তাঁর স্বামীর আরেক স্ত্রী আছেন। তাই তিনি স্বামীর কাছে তালাক চান। তবে টালবাহানা শুরু করেন সালমানুল। মোহরানার ২ লাখ ৩৮ হাজার টাকা ও তালাকনামা দিতে অস্বীকৃতি জানান। রাজধানীর এক হোটেলে আটকে মারধরও করেন। উপায় না পেয়ে ফিলিপাইনের তরুণী চট্টগ্রামে পরিচিত এক ফিলিপিনো পরিবারের কাছে থেকে কয়েক মাস ধরে প্রাপ্য আদায়ে ঘুরতে থাকেন। এক বাংলাদেশি তরুণের সহায়তায় চট্টগ্রামের খুলশী থানা থেকে এই তরুণীকে চলতি বছরের মার্চ মাসে ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগে পাঠানো হয়। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের উদ্যোগে অভিযুক্ত সালমানুল ইসলাম ও এইমি গ্রাসি মার্ভালিয়াসের উপস্থিতিতে একাধিক বৈঠক হয়। তালাকের পাশাপাশি মোহরানার টাকা ও ফিলিপাইনে ফেরত যেতে বিমান টিকিটের খরচ চান এইমি। অবশেষে ১৪ মার্চ বৈঠকে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের মধ্যস্থতায় সব অভিযোগ ও দাবি মেনে নিয়ে মোহরানার টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার সমঝোতা হয়। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার এইমিকে ১৭ মার্চ ফিলিপাইন দূতাবাসের সেফ হোমে হস্তান্তর করে। ৩১ মার্চ ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে সালমানুল মোহরানার টাকা প্রদান ও অন্যান্য দাবি মেনে নেওয়ায় ফিলিপাইন দূতাবাসের প্রতিনিধি, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, কাজি ও পরিবারের অন্য সাক্ষীদের উপস্থিতিতে এই দম্পতি খোলা তালাকে সই করেন। পরে এইমি ফিরে যান নিজের দেশে।
এই তরুণীকে সহায়তার হাত বাড়ানো বাংলাদেশি তরুণ মুনতাসির মাহমুদের ফিলিপাইনে যাওয়ার পর ইতিবাচক অভিজ্ঞতা ছিল। বাংলাদেশে এসে এই তরুণী যখন বিপদে পড়েন, তখন মুনতাসির এইমির ভিডিও করে সহায়তা চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগমের সঙ্গে এইমিকে নিয়ে সরাসরি দেখা করেন। তারপর আমেনা বেগমের সহায়তায় ঢাকার ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে আসার পর সমস্যার সুরাহা হয়।
চট্টগ্রামে অনার্স পড়ুয়া মুনতাসির মাহমুদ প্রথম আলোকে বললেন, ‘এইমির সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, বাংলাদেশি স্বামী তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। অনেক তথ্য গোপন করে বিয়ে করেছেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশি স্বামী এইমিকে বিয়ের নাম করে ফিলিপাইনে নানান সুবিধা ভোগ করেছেন। আর এইমি বাংলাদেশে আসার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য জানতেই পারেননি। শুধু স্বামীকে তালাক দেওয়ার জন্য এইমিকে দুবার বাংলাদেশে আসতে হয়। এই স্বামীর প্রতারণার বিচার চাইলে এইমিকে বাংলাদেশে থাকতে হতো আরও অনেক দিন, কিন্তু তা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তালাকের পরই তিনি দেশে ফিরে যান।’
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আমেনা বেগম বলেন, বিয়ের বর-কনে দেশি বা বিদেশি যা–ই হোক, বিয়ের মতো সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে সবাইকে আরেকটু সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আর বর্তমানে ফেসবুক প্রতারণার একটি ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, তাই এই মাধ্যম ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে। বিয়ের মতো সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে তো এ কথা আরও প্রযোজ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের শ্যারুন খানকে বিয়ে করা ফরিদপুরের ছেলে আশরাফ উদ্দিন জানালেন, বিদেশি মেয়ে বিয়ে করা ৫০ থেকে ৬০ জনের একটি গ্রুপ তৈরি করেছেন তাঁরা। নিজেরা কোনো সমস্যায় পড়লে তখন একে অন্যকে সহায়তা করেন।
আশরাফ বললেন, ছেলের চেয়ে বিদেশি মেয়ের আর্থিক অবস্থানসহ প্রোফাইল হাই হলে সবাই ভাবে, ছেলের কোনো না কোনো উদ্দেশ্য আছে। কিছু ক্ষেত্রে যে তা থাকে না তা নয়। তবে সবার বেলায় তা ঠিক নয়। বিয়ের এক মাস পরেই স্ত্রী তাঁর দেশে ফিরে গেছেন। সব মিলে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে উল্লেখ করে আশরাফ বললেন, অন্যান্য বিয়ের মতো বিদেশি মেয়েকে বিয়ের ক্ষেত্রেও স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতাটাই বড় বিষয়। আর এ ধরনের বিয়ে নিয়ে দেশের বেশির ভাগ মানুষের যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, তারও পরিবর্তন হওয়া জরুরি।